স্বাধীনতার ৭৪ বছর পেরিয়ে বিস্মৃতির অতলে ভারতের ‘ইহুদি গান্ধী’

কেরালার কোচি শহরের বুকে ঐতিহ্যবাহী মাট্টানচেরি প্যালেসে প্রতি বছর ভিড় জমান কয়েক হাজার পর্যটক। প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই স্থাপত্যকে ঘিরে রয়েছে জিউস স্ট্রিট। নামে ইহুদি যোগ থেকে গিয়েছে, কিন্তু আজ আর একজন ইহুদিও সেখানে নেই। কেউ পাড়ি দিয়েছেন ইজরায়েল কেউ আবার ইউরোপ বা আমেরিকার কোনো দেশে। শুধু পড়ে রয়েছে ইতিহাস। ইহুদি জনজাতির ইতিহাস এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। হ্যাঁ, ইহুদি জনজাতির মানুষদের হাত ধরেই গড়ে ওঠা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন আব্রাহাম বারাক সালেম। সেই সময় যাঁকে অনেকেই ‘ইহুদি গান্ধী’ বলে ডাকতেন। আজ অবশ্য স্বাধীনতার ৭৪ বছর পেরিয়ে এসে তাঁর কথা আর সেভাবে মনে রাখেননি কেউ।

ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস থেকে সাধারণভাবে মনে হয়, সমস্ত সাদা চামড়ার মানুষরাই বুঝি ভারতীয়দের পরাধীন করে রাখতে চেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও ব্রিটিশদের নানাভাবে সাহায্য তাঁরা করেছেন। আর ইহুদিরা তো ব্যতিক্রম ছিলেনই না। না, এইভাবে বিষয়টাকে দেখলেই ভুল থেকে যাবে। আর তার সবচেয়ে বড়ো দৃষ্টান্ত এবি সালেম। বাণিজ্যিক সূত্রে ইহুদিরা মালাবার উপকূলে আসতে শুরু করেছে ১৬শ শতকের মাঝামাঝি থেকেই। কোচি শহরে তাঁদের বিরাট বসতিও গড়ে উঠেছে। সেখানেই ১৮৮২ সালে জন্ম এবি সালেমের। এই সময় ইহুদিদের মধ্যে নানা ধরণের গোঁড়ামি প্রচলিত ছিল। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করলেই তাঁদের অপবিত্র ধরে নেওয়া হত। এছাড়াও বিধর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল।

১৯২০-র দশকে এইসব গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন এবি সালেম। এতদিন ইহুদিদের পরদেশি সিনাগগ গির্জা অপবিত্রদের বয়কট করত। সালেম নিজেই বয়কট করলেন সিনাগগ। পরদেশি সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করলেন তিনি। আর খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত সমর্থকদের নিয়ে যুক্ত হলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে। ১৯২৫ সালে কোচি আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন সালেম। তাঁর হাত ধরে একের পর এক অর্থনৈতিক সংস্কারের সাক্ষী থেকেছে মালাবার উপকূল। ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করেছিলেন গরিব চাষীদের খাজনা মকুব করতে। কিন্ত সালেম বুঝেছিলেন, এগুলোর কোনোটাই স্থায়ী সমাধান নয়। তাই ১৯২৯ সালের লাহোর কংগ্রেসে অনেকের মতো তিনিও পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন। দেশজুড়ে সত্যাগ্রহের ডাকে সামিল হলেন ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষরাও।

তবে এসবের মধ্যেও ১৯৩৩ সালে ইজরায়েল ভ্রমণে গিয়ে তাঁর মন এক অদ্ভুত মেদুরতায় ডুব দেয়। জিওনিস্ট আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মনে হয় সারা পৃথিবীতে ইহুদিদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে গেলে ইজরায়েলের গঠন অত্যন্ত জরুরি। আর তাই মালাবার উপকূলের ইহুদিদেরও তিনি ইজরায়েলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরের ৫ বছরের মধ্যে প্রায় সমস্ত ইহুদি পরিবার ইজরায়েলে চলে যায়। কিন্তু সালেম নিজে ভারত ছাড়তে পারেননি। এই দেশকেই যে তিনি নিজের দেশ মনে করেছেন ততদিনে। পরিবার নিয়ে থেকে গেলেন সিনাগগ ঘেঁষা একটা ছোট্ট বাড়িতে। স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে গিয়েছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে কোচি শহরেই মৃত্যু হয় তাঁর। স্বাধীনতার ইতিহাস যে এমনই অসংখ্য মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস। তাঁদের ভালোবাসার ইতিহাস। কিন্তু আমরা আর কজনকেই বা মনে রেখেছি? ইহুদি গান্ধীও হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে।

Powered by Froala Editor