রবীন্দ্রনাথ-রহমানকে একসূত্রে বাঁধলেন বাংলার একদল তরুণ শিল্পী

“রবীন্দ্রনাথ তো বিশ্বজনীন। ওঁকে এড়ানোর উপায় নেই। আর সাম্প্রতিক সময়ে দাঁড়িয়ে এআর রহমান ওয়ার্ল্ড মিউজিকে ম্যাপে উল্লেখযোগ্য একজন ফাদার ফিগার। ওঁকে ধরতে চাওয়াটাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। ওঁর কাজে তো অদ্ভুত একটা স্পেকট্রাম আছে, তার মধ্যে কোনো ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি বা অন্য কোনো বিভাজন নেই। তো সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে হয়েছিল যদি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুরের, চলনের সাযুজ্য নিয়ে যদি কাউকে ভাবা যায় সেটা এআর রহমান। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে, তবে আমরা কিন্তু একেবারেই তুলনা করতে চাইনি এই দুই ব্যক্তিত্বের।”

বলছিলেন কলকাতার তরুণ সঙ্গীতশিল্পী দীপাঞ্জন পাল। শুধু দীপাঞ্জনই নন, একদল বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রচেষ্টায় এবার একসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ এবং এআর রহমান। রবীন্দ্রনাথ এবং এআর রহমানের ‘যুগলবন্দি’ এই প্রথম নয়। বছর কয়েক আগেই, বিশ্বকবির ‘প্রার্থনা’ কবিতাটিতে সুরারোপ করেছিলেন অস্কারজয়ী সঙ্গীতপরিচালক। কিন্তু বিদ্যমান কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে আবহ দেননি তিনি। তাহলে যদি বিনির্মাণের মাধ্যমে নতুন করে আবিষ্কার করা যেত রহমান আর রবীন্দ্রনাথকে? সুরের খামখেয়ালীপনায় যদি তাঁরা হাত ধরেন একে অপরের, কেমন হবে সেটা? এমন এক ভাবনা থেকেই দুই প্রাণপুরুষকে একই আসনে বসিয়েছেন তরুণ বাঙালি শিল্পীদের দল 'হুজুগে'। নিজেদের মতো করেই এআর রহমানের আবহসজ্জাকে ধরতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুরে। দীপাঞ্জন ছাড়াও এই দলে রয়েছেন, অঞ্জিষ্ণু চৌধুরী, অঙ্কিতা ঘোষ, অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা, বল্লরী ভৌমিক, নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, প্রত্যয় রাহা, সোমদত্তা চৌধুরী, সমৃতা সাহা, শ্রবণা মুখার্জ্জী, রণদীপ মনু, সৌম্যদীপ। কাজের চাপে এই প্রোজেক্টে অংশ নিতে না পারলেও, 'হুজুগে' দলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জুড়ে রয়েছেন নৃত্যশিল্পী দেবলীনা কুমার।

“এআর রহমানের বিস্তৃতি সুদূরপ্রসারী। ফলে কতটা তাঁকে ধরতে পেরেছি জানি না। কিন্তু আমরা ফিউশন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছি ঠিকই, তবে রবীন্দ্রনাথের গান যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতই মনে হয়, সেই ব্যাপারটা সবসময়ই খেয়াল রেখেছি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, লয়, স্বরলিপি মেনেই প্রতিটা গান করেছি আমরা”, বলছিলেন দীপাঞ্জন। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে একাধিক গান প্রকাশ করলেও, এই ছোট্ট দলের এখনও সেইভাবে কোনো নামই ঠিক করে উঠতে পারেননি তরুণ শিল্পীরা। আপাতত ‘সুরকাহন’ ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁদের গানগুলি।

আসলে, রবীন্দ্র-রহমান ফিউশনের এই যাত্রাপথটাও যে শুরু হয়েছিল আকস্মিকভাবে। হ্যাঁ, এই লকডাউনেই। বাঙালি হলেও, এই প্রোজেক্টের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন গোটা দুনিয়ায়। কেউ বর্তমানে দিল্লি, মুম্বাইতে বসবাসরত; কেউ আবার থাকেন যুক্তরাজ্যে। ন’মাসে ছ’মাসে যে সাক্ষাতের সুযোগ— সেটাও কেড়ে নিয়েছিল মহামারীর আবহ, লকডাউন। বাড়িতে বসেই তখন একত্রে সঙ্গীতচর্চার জন্য ভার্চুয়াল মিডিয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন তরুণ শিল্পীরা। ভিডিও কলের মাধ্যমেই পালিত হয়েছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী। সেখান থেকেই রেকর্ডের চিন্তাভাবনা। “বিভিন্ন জায়গা থেকে গান রেকর্ড করা হত মোবাইলে। তারপর যুক্তরাজ্যের আমাদেরই এক প্রবাসী বন্ধু সেগুলি এডিট করে দিত। খানিক আনপ্রফেশনাল ভাবেই শুরু করেছিলাম আমরা। প্রচুর মানুষ আমাদের এই উদ্যোগকে সমর্থন জানান। পরবর্তীতে লকডাউন শিথিল হতে, আমরা প্রফেশনালভাবে রেকর্ড করি পরের গানগুলি”, বক্তব্য দীপাঞ্জনের। 

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার ৭৪ বছর পেরিয়ে বিস্মৃতির অতলে ভারতের ‘ইহুদি গান্ধী’

আরও পড়ুন
নাৎসিদের বিরুদ্ধে গানই অস্ত্র ‘জলদস্যু’দের, দিতে হয়েছিল প্রাণও

গত বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের প্রথম গান ‘আওয়াজ দো হাম এক হ্যায়’। চলতি বছরের বসন্ত উৎসব এবং স্বাধীনতা দিবসেও দুটি নতুন গান প্রকাশ করেছেন তাঁরা। 

আরও পড়ুন
সংস্কার শেষ, বেলেঘাটার গান্ধীভবনের দরজা খুলবে শীঘ্রই

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, অন্য একটা জায়গায়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালি চিরকালই স্পর্শকাতর। রবীন্দ্রসঙ্গীতে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেও ফুঁসে ওঠে বাঙালি। সেখানে দাঁড়িয়ে এমন একটা উদ্যোগে কতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের? খানিক হেসে দীপাঞ্জন জানালেন, “এখনও পর্যন্ত সেই ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া আমরা পাইনি। যারা শুনেছেন সকলেই ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তবে আমরা যারা যারা গেয়েছি সকলেই যেহেতু দক্ষিণী সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনী, ফলত আমরা ওই ঘরানাটার মধ্যেই বিলং করি। কাজেই আমাদের মধ্যেও সবসময় একটা ভয় কাজ করে, আমাদের গুরুরা কী বলবেন। আমরা কাজ করার আগে দশবার ভেবে গানের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখেই সেগুলোর ফিউশন করেছি। তবে একথা ঠিক প্রত্যেক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন এবং তাঁদের সেই মতামতটাও আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।”

দূরত্বের জন্য এই মুহূর্তে সরাসরি গান মঞ্চস্থ করার সুযোগ নেই। তবে আগামীতে ভার্চুয়াল মাধ্যমের সূত্র ধরেই আরও নতুন নতুন গান যে আসতে চলেছে, সেই ইঙ্গিতই দিলেন দীপাঞ্জন। রবীন্দ্রনাথ যে চির-আধুনিক এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেও যে তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছেন বাঙালির কাছে— সেকথাই যেন আরও একবার প্রমাণ করিয়ে দিচ্ছে তরুণ শিল্পীদের এই প্রচেষ্টা…

Powered by Froala Editor