দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন নিয়ে সারা দেশ তোলপাড়। সব বাড়িতে জাতীয় পতাকা তোলার ফরমান। কিন্তু আমাদের বাড়িতে ১৫ আগস্ট, ২৩ জানুয়ারি এবং ২৬ জানুয়ারি পতাকা তোলা ও নিয়ম মেনে সন্ধের আগে তা নামিয়ে আনার রেওয়াজ রয়েছে। কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িতেও বাবার উদ্যোগে আমি পতাকা তুলেছি অনেকবার। নিজের তাগিদে বা কর্তব্যবোধেই হয়তো এতদিন আমাদের বাড়ির বড়োরা এই কাজ করতেন। আমরাও জানতাম, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পরিবারের সামান্য হলেও কিছু অবদান রয়েছে।

ছোটোবেলা থেকেই বাবার কাছে তাঁর ঠাকুরদার (পিতামহ), প্রফুল্ল কুমার নিয়োগীর (Prafulla Kumar Niyogi) গল্প শুনতাম। বাবার ছোটোবেলা কেটেছে রায়গঞ্জে। প্রফুল্ল কুমার নিয়োগী ছিলেন খুবই স্নেহময় মানুষ, আমার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবার কাছে শুনেছি, উনি ওঁর কৈশোর ও যৌবনের বেশ কিছুটা সময় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯০৮ সালে, যখন ১৫ বছর বয়স প্রফুল্লর, অশ্বিনীকুমার দত্ত দিনাজপুরে আসেন শিক্ষকতার কাজে। অনুশীলন সমিতির দিনাজপুরের শাখার কাজ উনিই দেখতেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদরদী শিক্ষক। অনেক ছাত্র তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গুপ্ত বিপ্লবী দল— অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন। 

সে-বছরই ঘটল দিনাজপুরে সাড়া জাগানো ‘ল্যাজারার্স ব্রাদার্স অ্যাসল্ট কেস’। এই ঘটনাটা বাবার কাছে শুনে আমি ছোটোবেলায় এর গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। মনে হয়েছিল, এ আর এমন কী ব্যাপার! কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনের শুরুর লগ্নে এই ঘটনার বিরাট ভূমিকা ছিল। 

আরও পড়ুন
গান্ধীজির আদর্শে আজীবন লড়াই, পদ্মশ্রী পেলেন দমনের বৃদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামী

ঘটনা ছিল এইরকম: 

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার আগেই বাংলায় গড়ে উঠেছিল যে-সমস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

সেদিন স্কুলের ছুটি শুরু। বিকেলে অশ্বিনীবাবুকে ট্রেনে তুলে দিতে এসেছিলেন তাঁর ছাত্ররা। খুব ভিড় ছিল, তাই বাধ্য হয়েই ছাত্ররা তাঁদের শিক্ষককে একটা প্রথম শ্রেণির কামরায় তুলে দেন। সেই সময় কোনো-কোনো প্রথম শ্রেণির কামরায় ‘ইউরোপিয়ানস ওনলি’ লেখা থাকত। নেটিভদের ওঠা বারণ। ওই কামরাটিতে দুজনই মাত্র যাত্রী— চশমার ব্যবসায়ী ল্যাজারার্স ভ্রাতৃদ্বয়। ছাত্রদের অনুরোধে পাত্তা না-দিয়ে তারা অশ্বিনীবাবুর জিনিসপত্র লাথি মেরে প্ল্যাটফর্মে ফেলে দেয়। ব্যাস, এই অপমানের জবাব দিতে ছাত্ররা দুই সাহেবকে প্ল্যাটফর্মে টেনে নামিয়ে প্রচণ্ড প্রহার করে, তাদের সব জিনিসপত্র ভেঙে তছনছ করে দেয়। ঘটনাটি ঘটে সন্ধের কিছু আগে। দুই সাহেব প্রহৃত হবার খবর ছড়িয়ে যায় দ্রুত। পুলিশ দিনাজপুর স্টেশন ও সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে গ্রেপ্তার করে কয়েকজনকে। 

আরও পড়ুন
‘এই স্বাধীনতার জন্য লড়িনি’, মৃত্যুর আগেও আক্ষেপ করেছিলেন শতবর্ষী সুধাংশু বিশ্বাস

পরদিন গ্রেপ্তার হন অশ্বিনীকুমার দত্ত। ‘সাহেব পিটুনি’র এই ঘটনা দিনাজপুরের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। 

বিপ্লবীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও অনুশীলন সমিতির স্রষ্টা প্রমথনাথ মিত্র। কয়েকজন যুবক ছাড়া পান। কিন্তু তারাদাস ঘটক, দক্ষিণারঞ্জন বসু, অশ্বিনীকুমার দত্ত ও প্রফুল্ল কুমার নিয়োগীর দেড় বছর জেল হয়।

জুভেনাইল প্রিজনার হিসেবে প্রফুল্ল কুমার এক বছর পরে ছাড়া পান।

ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত তাম্রপত্র

 

এরপর তিনি অশ্বিনীকুমার দত্ত মহাশয়ের অনুমতি নিয়ে অনুশীলন সমিতির কাজে আর সরাসরি যুক্ত থাকেননি। কেন তিনি অনুশীলন সমিতি ছেড়েছিলেন, তা একদিন বাবাকে বলেছিলেন কথায়-কথায়। তাঁর কারাবাসের সময়েই ঘটে ক্ষুদিরামের ফাঁসি; কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওপর অকথ্য পুলিশি অত্যাচারের ঘটনা। তিনি বাবাকে বলেছিলেন ‘আমি জেলে থাকতেই এইসব অত্যাচারের খবর পেতে থাকি। ভয় পাই। জেল থেকে বেরিয়ে অশ্বিনীবাবুকে জানাই আমার দুর্বলতার কথা। বলি, স্যারের এ-রকম অত্যাচার আমি হয়তো সহ্য করতে পারব না, হয়তো সংগঠনের গুপ্তকথা মারের চোটে প্রকাশ করে ফেলব। অশ্বিনীবাবু বুঝতে পারেন আমি সত্যি কথা বলছি। তিনি আমাকে গুপ্ত সমিতি ছাড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।’ আসলে এই সব দলে ঢুকলে বেরিয়ে আসা অত সহজ ছিল না। 

এর পরের পর্বে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কাজে যুক্ত হন । 

তবে প্রফুল্ল কুমারকে নিয়ে এত খবর আমাদের জানা ছিল না। সম্প্রতি আমার বাবা ধনঞ্জয় রায়ের লেখা ‘দিনাজপুর জেলার  ইতিহাস’ বইটি কিনেছিলেন। সেই বই থেকে জানতে পারলাম, ১৯২১ সালে বালুরঘাট শহরে প্রফুল্ল কুমার নিয়োগী, চুনী নিয়োগী ও প্রভাপ্রসন্ন নিয়োগীর উদ্যোগে ‘ন্যাশনাল স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়টা আশা করি খেয়াল করলেন! অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

ওই বইটি থেকেই আরও জানা গেল, বালুরঘাটে প্রথম কংগ্রেসের শাখা অফিস তৈরি হয় প্রফুল্ল কুমার নিয়োগী-র বাড়িতে। 

এ-সব তথ্য বাবাও জানত না। কারণ তার ঠাকুরদা নিজের মুখে স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবনের কথা প্রায় কখনও বলতেন না। সম্ভবত দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল হয়ে ভারতের নতুন মানচিত্রের মধ্যে পালিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা স্বাধীনতা প্রাপ্তির আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছিল।

তাই এই অবজ্ঞাত ও স্বেচ্ছা-নির্বাসিত স্বাধীনতা সংগ্রামীকে যখন স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী বর্ষে ভারত সরকার তাম্রপত্র দিয়ে সম্মাননা জানায়, তখন তাঁর দ্বিধার কথা বাবার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো কিছুই করিনি তেমন। এই সম্মানের যোগ্য নই।’ পরিবার-পরিজনের অনুরোধে শেষ অবধি তিনি তাম্রপত্র গ্রহণ করেছিলেন।

আমি ইতিহাসের ছাত্রী, এখন একটি বেসরকারি স্কুলে ইতিহাস পড়াই। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস পড়াতে পড়াতে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এরকম কত মানুষ আছে যাঁদের কথা পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ পায় না, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় কোথাও-না-কোথাও ঠিক থেকে যায়।

(লেখক স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রফুল্ল কুমার নিয়োগীর প্রপৌত্রী)

Powered by Froala Editor

More From Author See More