অরবিন্দের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যে ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’, কারাদণ্ড বিপিনচন্দ্র পালের

তাঁর জন্মের এক বছর আগে ঘটে গেছে সিপাহী বিদ্রোহ। পরের বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পালা চুকিয়ে ভারতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন স্বয়ং ইংল্যান্ডেশ্বরী। পরাধীন দেশে ইংরেজ অত্যাচার আর শোষণের বিন্দুমাত্র বদল ঘটেনি তাতে। শ্রীহট্ট জেলা ছিল তখন ঢাকা বিভাগের অধীনে। তার বছর কুড়ি পরে বাঙালি অধ্যুষিত শ্রীহট্ট-কাছাড় যুক্ত হয় আসাম জেলায়। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির বাতাবরণ ছিল এখানে। উৎসব-অনুষ্ঠানে চলত ভাবের বিনিময়। কিন্তু ফল্গুধারার মতো একটা বিভাজন সর্বদাই ছিল সামাজিক চেতনার অন্তরে। প্রকাশ্য বিরোধিতায় না হলেও, আচার-আচরণের সূক্ষ্মস্তরে প্রায়ই ধরা পড়ত ধর্মগত বিভেদরেখা। বিপিনচন্দ্র পালের (Bipin Chandra Pal) স্কুলজীবনের একটি অত্যন্ত সাদামাটা ঘটনা বহন করে তারই সাক্ষ্য।

ফারসি শেখার জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল এক মৌলবির কাছে। আবার প্রবল মার খেয়েছিলেন জনৈক মুসলিমের ‘ছোঁয়া জল’ পান করার জন্য। শ্রীহট্টে সোডা ওয়াটার আর লেমনেড নিয়ে স্কুলের ছাত্রদের বিক্রি করতে আসতেন এক মুসলিম ভদ্রলোক। বন্ধুদের সঙ্গে মিশে প্রায়ই স্বাদ উপভোগ করতেন এই নতুন ধরনের পানীয়ের। কিন্তু একদিন ভুল হয়ে গেল টাকা দিতে। আর সেই ভদ্রলোক এসে উপস্থিত উকিল পিতা রামচন্দ্র পালের কাছে। তিনি তখন সদ্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন আদালতে যাওয়ার। সমস্ত ঘটনা শুনে চরম শাস্তির ব্যবস্থা হল বিপিনচন্দ্রের জন্য। একে তো উপযুক্ত মূল্য না দিয়ে খাবার খেয়েছে, যা প্রায় চুরির সামিল। দ্বিতীয়ত, মুসলিমের হাতের জল ছুঁয়েছে। মনে করলেন, ইংরেজি শিক্ষার জেরেই এই অবনতি হয়েছে পুত্রের। ছ’মাসের জন্য স্কুল থেকে পর্যন্ত ছাড়িয়ে দেওয়া হল তাঁকে।

কয়েকমাস পরের কথা। পেটের সমস্যায় তখন প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন বিপিনচন্দ্র। গলা শুকিয়ে পুরো কাঠ। ডাক্তার বিধান দিলেন, লেমনেড খাওয়া যেতে পারে। সেই মুসলিমের কলে তৈরি লেমনেড ফিরে এল জীবনে। পুরনো কথা কিছুই ভোলেননি তিনি। জেদ ধরে বসে রইলেন, কিছুতেই এই ‘ওষুধ’ মুখে তুলবেন না। শেষে ঘরভরা লোকের সামনে পিতা নিজের হাতে বিপিনচন্দ্রের মুখে তুলে দিলেন মুসলমানের হাতে ছোঁয়া জল। এমনই জেদ ছিল তাঁর ছোটোবেলা থেকে। দৃঢ় সংকল্প আর লৌহকঠিন মানসিকতার জন্য সমীহ করে চলত ইংরেজও। কিংবদন্তির ‘লাল-বাল-পাল’-এর যুগপুরুষ বিপিনচন্দ্র বাংলার ধর্ম, সমাজ, রাজনীতিতে নিজের জীবনদর্শনের প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বহুভাবে।

এই উন্নত ও উদার সমাজচেতনার জন্যই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন ব্রাহ্মসমাজে। ধর্মীয় মতবাদ নয়, বরং খুঁজতে চেয়েছিলেন দেশভক্তি। কেশবচন্দ্র সেনের বদলে সেই আদর্শের সন্ধান পান শিবনাথ শাস্ত্রীর। কলকাতায় তখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বাদ্য বেজে উঠতে শুরু করেছে ঢিমেতালে। নাটকে, গানে, কবিতায়, এমনকি উৎসব আয়োজনের মধ্যেও লেগেছে ব্রিটিশ বিরোধিতার আঁচ। ধর্মীয়ভাবে সংকীর্ণ ও ‘নরমপন্থী’ রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও প্রথম পর্বের কার্যকলাপ হিসেবে তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ক্রমে তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে বহু মানুষের মধ্যে। বিপিনচন্দ্র এই সময়ে বেশ কয়েকবার ইউরোপে যান। বুয়র যুদ্ধ-সহ ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী নীতির বেশ কয়েকটি নমুনা তাঁকে ক্রমে ঠেলে দিতে থাকে ‘চরমপন্থী’ দিকে। 

আরও পড়ুন
বাবার দেওয়া নাম ‘অ্যাক্রয়েড’, যৌবনে পৌঁছে প্রথম বাংলা শেখেন ‘সাহেব’ অরবিন্দ ঘোষ

১৯০৩-র ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত হয় বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব। বাংলাব্যাপী জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের আগুন। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পূর্ববঙ্গ ও আসামের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতায় মানুষের মনে ছড়িয়ে দেন ব্রিটিশবিরোধী বাণী। পুলিশ রিপোর্টে তাঁকে নিয়ে বলা হয়েছে, 

আরও পড়ুন
ক্ষুদিরামকে নিয়ে সিনেমা, তথ্যের যোগান দিলেন বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের বিপ্লবী ভাইয়েরা

“জেলাগুলি যখন শান্ত হয়ে আসে, বয়কট থেমে যায়, এবং আন্দোলন মুমূর্ষু হয়ে পড়ে, তখনই বিপিনচন্দ্র পাল অথবা আবদুল গফুরকে, বিশেষ করে বিপিনচন্দ্র পালকে, উত্তেজনা জাগিয়ে তোলার জন্য পাঠানো হয়। তিনি যেখানেই যান, সেখান হতে চলে আসবার পর সেই জায়গায় তাঁর প্রভাব অন্যান্য আন্দোলনকারীদের চেয়ে ঢের বেশি অনুভব করা যায়।”

এই সময়ে ইংরেজ সরকার জাতীয়তাবাদী একাধিক পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেন। তাছাড়া বাংলাতে চরমপন্থীদের বিশেষ কোনো মুখপত্র ছিল না। ১৯০৭ সালে দুই বন্ধুর সাহায্য নিয়ে বিপিনচন্দ্র পাল শুরু করলেন ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকা। যার মূলমন্ত্র ছিল ‘ইন্ডিয়া ফর ইন্ডিয়ানস’। ঋষি অরবিন্দ জানাচ্ছেন, তিনি ছিলেন এই পত্রিকার প্রথম সহকারী-সম্পাদক। যদিও দু’জনের রাজনৈতিক কর্মপন্থায় তফাৎ ছিল যথেষ্ট। 

এই বছরই বন্দে মাতরম পত্রিকায় ‘পলিটিক্স ফর ইন্ডিয়ানস’ প্রবন্ধ এবং যুগান্তরে কয়েকটি নামবিহীন প্রবন্ধের জন্য রাজদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন অরবিন্দ ঘোষ। পরোয়ানা জারি হল বন্দে মাতরমের দুই কর্মাধ্যক্ষের বিরুদ্ধেও। পত্রিকার অফিস তল্লাশি করে মিলল বিপিনচন্দ্রের স্বাক্ষর করা পত্র। যার সূত্র ধরে তাঁকে আদেশ দেওয়া হয় সাক্ষ্যদানের জন্য। কিন্তু অরবিন্দের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলেন না তিনি। বলা যায় ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ অবলম্বন করলেন। এই লেখা প্রকাশে তাঁর আপত্তি রয়েছে স্বীকার করেও বললেন, “আমার বিবেক এই ধরনের অন্যায় ফৌজদারি মামলায় সাহায্য করতে আমাকে জোরালো ভাষায় নিষেধ করছে। এর জন্য যদি আমায় শাস্তি হয়, বেশ, তাই হোক।” ১০ সেপ্টেম্বর রায় বেরোল মামলার। ছ’মাসের কারাদণ্ড হল বিপিনচন্দ্রের। প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেল ও পরে বক্সার। আর সেখানে বসেই তিনি লিখলেন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জেলের খাতা’। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্রাহ্মমুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব। জাতীয়তাবাদী চেতনায় নতুন মোড় এসেছিল তাঁর হাত ধরে। ধর্ম-সংস্কারের ঊর্ধ্বে দেশমাতৃকার স্থান দিতে পেরেছিলেন বলেই তৎকালীন বহু রাজনৈতিক নেতার থেকে পৃথক ছিল জীবনদর্শন। যে কারণে তিনি বলতে পেরেছিলেন, 

“এ জগতে আসিয়া ভারতবর্ষে জন্মিয়াছি ইহা সৌভাগ্যের কথা। আবার যদি এই সংসারে জন্মিতে হয়, তাহা হইলে এই ভারতবর্ষেই জন্মিতে চাই, সুখ-সমৃদ্ধিশালী অন্য কোন দেশে জন্মিতে চাহি না।”

Powered by Froala Editor