প্রয়াত কিংবদন্তি শিক্ষক দুলাল চন্দ্র সাঁতরা, অসম্পূর্ণই রইল জীববিদ্যার ক্লাস

তাঁর নামেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক কিংবদন্তি। জীববিদ্যা এবং দুলাল চন্দ্র সাঁতরা— এই দুই সমার্থক হয়ে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের কাছে। একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণীতে জীববিদ্যার বই বলতে আজও বিকল্প নেই দুলাল চন্দ্র সাঁতরার। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও লিখেছেন জীববিদ্যার বহু গ্রন্থ। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। নিজের কর্মযজ্ঞ ফেলেই চোখ বুজলেন কিংবদন্তি শিক্ষক, লেখক। পড়ে রইল অসম্পূর্ণ ক্লাস...

এদিন প্রহরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় সাঁতরা পাবলিকেশনস-এ। আধিকারিকরা জানান, বুধবার সকালেই বেলভিউ নার্সিংহোমে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও।

১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের গ্রাম বীরসিংহে জন্ম দুলাল চন্দ্র সাঁতরার। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন মেদিনীপুরেই। এরপর স্নাতক স্তরের পড়াশুনো সিটি কলেজ থেকে এবং স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশুনো শেষ করে পেশা হিসাবে বেছে নিলেন শিক্ষকতাকেই। প্রথম চার বছরে চারটি আলাদা আলাদা স্কুলে পড়িয়ে অবশেষে মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলে এসেই থিতু হয়েছিলেন দুলাল চন্দ্র সাঁতরা। সেখানে ২৯ বছর শিক্ষকতার পর ২০০৫ সালে অবসর নিয়েছেন।

এই স্কুলেই পড়াশুনোর যাবতীয় বিষয়বস্তুকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলেন সাঁতরাবাবু। আর তাঁর পড়ানোর ধরন তাই খুব সহজেই আকর্ষণ করেছিল ছাত্রদের। জনপ্রিয়তা এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে মধ্যমগ্রামের অন্য স্কুলের ছাত্ররাও একদিন তাঁর ক্লাস করতে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে শুরু করলেন একটি কোচিং সেন্টার। 

ক্লাসে ছাত্রদের সঙ্গে তৈরি করে রাখতেন বন্ধুসুলভ এক পরিবেশ। গল্প, খুব সহজ কিছু উদাহরণের মাধ্যমেই তুলে ধরতেন গুরুগম্ভীর বিষয়কে। “কোনো এক স্যার আসেননি বলে তাঁর দায়িত্ব পড়ে সেভেন কে একটা পিরিয়ড পড়াতে৷ তিনি এলেন, মন্ত্রমুগ্ধ গোটা ক্লাস। বকঝকা নেই, মারধোর নেই৷ পুরো বন্ধু যেন৷ তিনি বুঝতেন সেই সময় থেকে বয়ঃসন্ধিকালে যৌন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা৷ যা সেই সময় কল্পনাতীত৷”, স্মৃতিচারণায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর কথা তুলে আনেন অরুণাভ মিত্র। ছাত্রের আসনে সামনে থেকে দুলাল চন্দ্র বাবুর পড়ানোর ম্যাজিকের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তিনি।

শুধু শিক্ষকতাই নয়, দুলাল চন্দ্র সাঁতরা তৈরি করেছিলেন প্রান্তিক ও মৌলিক লাইব্রেরি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব প্রকাশনা সংস্থা ‘সাঁতরা পাবলিকেশন’। জীববিদ্যা ছাড়াও পদার্থবিদ্যা থেকে শুরু করে রসায়ন, সব বিষয়েরই পাঠ্যপুস্তক প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন তিনি। নিজে লিখেছেন স্কুল থেকে স্নাতক স্তরের পুষ্টি, জীববিদ্যার বিভিন্ন বই। বাদ যায়নি মেডিক্যালের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির বই-ও।

আরও পড়ুন
প্রয়াত শন কনেরি, উল্টে গেল জেমস বন্ডের একটি পাতাও

এই কিংবদন্তীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুমিত মণ্ডল জানালেন, “আমরাও পড়েছি ওনার লেখা বই। বেসিক সায়েন্সে ভিদ তৈরি করতে ওনার বইয়ের বিকল্প নেই কোনো। পরে হায়ার এডুকেশনে বিষয় ভাগ হয়ে গেলেও, পূর্ববর্তী ধারণাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে থাকে সব সময়ই। আর ঠিক এই জায়গাটার জন্যই, উনি না থাকলেও ওঁর বই চলতে থাকবে যুগের পর যুগ ধরে।”

শেষ জীবনেও প্রায় প্রতিদিনই শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের অফিসেই ৪-৫ ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন দুলালবাবু। বদলে যাওয়া সিলেবাসের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয়, ক্রমাগত পরিবর্তন করেছেন অধ্যায়ের পাঠের ধরণ। ছাত্রদের সুবিধার জন্যই বদলেছেন বইয়ের বিষয়বস্তুও। তবে বর্তমানে বোর্ড পরীক্ষার অবজেক্টিভধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থায় খুশি ছিলেন না তিনি। চাইতেন যে কোনো বিষয়ে বিস্তারিতভাবেই যেন পাঠগ্রহণ করে ছাত্ররা। চাইতেন বইয়ের মধ্যে দিয়েই যেন নেওয়া যায় একটা কমপ্লিট ক্লাস। অসম্পূর্ণ রয়ে গেল সেই উদ্দেশ্যই। তবে রয়ে গেল তাঁর লেখা বইগুলি। যুগের পর যুগ ধরে তা যে সঙ্গ দেব সাফল্যের, তা আর নতুন করে বলার নয়...

তথ্যঋণ – 'জীববিদ্যার কিংবদন্তি শিক্ষক দুলাল চন্দ্র সাঁতরা, যার ক্লাসে ইউনিফর্ম ধার করে ঢুকতে চাইত অন্য ছাত্ররা', কৃশানু ঘোষ, নিউজপোল
ছবি ঋণ – দিলীপ সাঁতরা
বিশেষ কৃতজ্ঞতা - সুমিত মণ্ডল, সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অফ লাইফ সায়েন্স, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
প্রয়াত ইউরেনিয়াম-বিরোধী আন্দোলনের ‘জননী’ কং-স্পিলিটি, শেষ হল মেঘালয়ের একটি অধ্যায়

Powered by Froala Editor

Latest News See More