তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দাবি-সনদ, লক্ষ্য বাংলার রাজনৈতিক দলগুলি

ইতিমধ্যেই বাংলায় শুরু হয়ে গেছে নির্বাচন। আর তারও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ভোটের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই প্রকাশ করেছিল তাদের ইস্তেহার। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই কোথাও যেন উপেক্ষিত হয়েছেন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষরাই। কোথাও নামমাত্র উল্লেখিত হয়েছে তাঁদের কথা, কোথাও বা হয়ইনি। এবার তাঁদের জন্যই অভিনব উদ্যোগ নিল বাংলার একটি অলাভজনক সংস্থা ‘কলকাতা কমন্স’। প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের দাবি-দাওয়াগুলি তুলে এনে উপস্থাপন করল একটি দাবি-সনদ।

নির্বাচন শুরুর ঠিক আগেই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছেই এই দাবি-সনদ জমা দিয়েছে ‘কলকাতা কমন্স’। কিন্তু কীসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই দাবি-সনদ? “এখানে যে-কটি দাবি রয়েছে, প্রতিটি দাবিই করেছেন এলজিবিটি কমিউনিটির কোনো না কোনো মানুষ। সেখানে কোনো সম্পাদনা বা সেনসরশিপ করিনি আমরা। একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল বাংলার বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে। বিভিন্ন এনজিও-র সংগ্রহ করা তথ্যগুলিকে সংকলন করেই আমরা এই দাবি-সনদ প্রস্তুত করেছি। জানতে চেয়েছি এই প্রস্তাবগুলিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মতামত”, বলছিলেন ‘কলকাতা কমন্স’-এর সদস্য অশেষ সেনগুপ্ত। 

সাধারণত দাবি-সনদ পেশ করা হয় কোনো ক্ষমতাসীন দল কিংবা কোনো অধিকর্তার কাছে। তবে এক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। মানুষের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ানো প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছেই ‘উপেক্ষা’-র প্রশ্ন তুলে ধরেছে দাবি-সনদটি। “আমার কিছু দরকার সেটা আমি সরকারকে জানালাম তেমনটা নয়। আসলে সমাজের মধ্যে প্রান্তিকতার সঙ্গে ভাষার আদান-প্রদানের যে সমস্যা রয়েছে, সেটাই এই দাবি-সনদের কনটেক্সটকে তৈরি করে দিয়েছে”, জানালেন অশেষবাবু। কিন্তু কী আছে সেখানে?

সব মিলিয়ে মোট ২২টি পৃথক পৃথক ক্ষেত্রের দাবি উঠে এসেছে সেই সমীক্ষা থেকে। সেখানে যেমন উঠে এসেছে সাংবিধানিক অধিকারের কথা, তেমনই উল্লেখিত হয়েছে প্রশাসনিক আইন সংস্কার, তৃতীয় লিঙ্গ মানুষদের সুরক্ষা, শিশু সুরক্ষা, সন্তান দত্তক নেওয়ার মতো প্রসঙ্গও। সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য বিশেষ শৌচাগারের দাবি কিংবা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ওয়ার্ড চালু করার আবেদন। প্রশাসনিকস্তরে তৃতীয় লিঙ্গ-ক্ষমতায়নে বিশেষ নজর না দেওয়াকেও প্রশ্ন করেছেন অনেকে। এবং সর্বোপরি উল্লেখযোগ্যভাবে সেখানে উঠে এসেছে এনআরসি, সিএএ-এর প্রসঙ্গ।

আরও পড়ুন
আমাজন-ফ্লিপকার্টে কাজ পাবেন রূপান্তরকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও

প্রতিটিই দাবিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে। তারপরেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সেগুলো এড়িয়ে গেল কেন তাঁদের ইস্তেহারে? সেখানেই থেকে যায় প্রশ্ন। তবে কি সংখ্যালঘু বলেই খানিক খাটো করে দেখা তাঁদের সমস্যাগুলিকে? তা-ই উঠে এল অশেষবাবুর কথায়, “পরিসংখ্যান বলছে, বাংলায় তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দেড় হাজারের মতো। আসলে সংখ্যা দিয়েই খুব বড়ো মিথ্যে কথা বলা যায়। সেটাই হচ্ছে। সংখ্যা দিয়েই ট্রিভিয়ালাইজ করে দেওয়া হচ্ছে বিষয়গুলিকে। অথচ তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে গোটা সমাজের জন্য এনআরসি, সিএএ-এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তাঁরা নিজেরা বাধ্য হয়েছেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। ফলে তাঁদের পক্ষে এই যাচাই প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ভীষণভাবে কঠিন। পাশাপাশি যে প্রক্রিয়াটা হবে সেখানেও যে তাঁদের সমকক্ষ হিসাবেই দেখা হবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।” 

কিন্তু এই দাবি-সনদের প্রেক্ষিতে কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলি? জানা গেল অধিকাংশ দলই এখনও পর্যন্ত কোনো প্রত্যুত্তর দেয়নি এই বয়ানের। কেউ কেউ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আলোচনা করে দেখবেন গোটা বিষয়টাই। তবে স্পষ্ট করে এই দাবি-সনদের কথাগুলোকে এখনও পর্যন্ত নিজেদের ইস্তেহারে জায়গা করে দেয়নি কেউ-ই।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য মাদ্রাসা, দিনবদলের ইঙ্গিত পাকিস্তানে

প্রান্তিক লিঙ্গ এবং যৌনতার মানুষদের নিয়ে বর্তমানে কাজ করে চলেছেন বহু বহু সমাজকর্মী, অলাভজনক সংস্থা। কিন্তু কোথাও সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না প্রশাসনিক স্তরে। যার ফলে পুরো বিষয়টার মধ্যে সমন্বয়সাধন করাই হয়ে উঠেছে দুষ্কর। অন্যদিকে অলাভজনক সংস্থার ক্ষমতাও সীমিত। এই বৈষম্যের ইতি টানতে পারে একমাত্র প্রশাসনিক পদক্ষেপই। “বাংলায় প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদের কল্যাণের জন্য যে কমিটি রয়েছে সেখানে তাঁদেরই রাখা হয়নি। সেটা উঠে এসেছে দাবিতেও। বলা হয়েছে রাজ্যস্তর থেকে গ্রামস্তর পর্যন্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। এবং সেখানে যুক্ত করতে হবে স্থানীয় কমিউনিটির মানুষদেরই। কারণ, একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে একটি কমিউনিটির কী সমস্যা সেটা বোঝা সম্ভব নয়। কলকাতায় বসে একটা প্রান্তিক অঞ্চলের সমস্যাটা বোঝা সম্ভব নয়”, বলছিলেন অশেষবাবু। 

তবে শুধু তৃতীয় লিঙ্গ মানুষদের জন্যই নয়। সব মিলিয়ে প্রান্তিক মানুষদের দাবি নিয়ে মোট ১২টি দাবি-সনদ প্রকাশ করেছে ‘কলকাতা কমন্স’। অশেষবাবুর কথায় আবেদন একটাই, ‘প্রান্তিক বলে দূরে ঠেলে দিও না।’ প্রান্তিক মানুষদের সেই লড়াইয়ের আগুনটাকেই যেন সঙ্ঘবদ্ধ করে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছেই তুলে আনছে এই সংস্থা। তার প্রতিফলন বাস্তবে কতটা পড়বে, সেটাই এখন দেখার…

আরও পড়ুন
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বড়ো প্রাপ্তি; পরিচয় পেতে আর বাধ্যতামূলক নয় মেডিক্যাল পরীক্ষা

Powered by Froala Editor