মৃত্যুর পর সমস্ত লেখা পুড়িয়ে দিতে বলেছিলেন কাফকা, অনুরোধ রাখেননি বন্ধু

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছেন এক ব্যক্তি। রোগাটে চেহারাটা আরও জীর্ণ হয়ে গেছে; মৃত্যুর আতর যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। চারিদিকে পড়ে রয়েছে অসংখ্য কাগজ, বই, চিঠি। কাগজগুলোয় লেখা আছে গল্প। বিছানা থেকে কোনোক্রমে উঠে সেইসব তুলে ধরলেন মানুষটা। ছুঁয়ে দেখলেন নিজের লেখাগুলোকে। তারপর ফায়ারপ্লেসের আগুনে ঢেলে দিলেন সমস্ত সৃষ্টি। সমস্ত না, অশক্ত শরীর সেই কাজ করতে পারেনি। তবে চিঠিতে প্রিয় বন্ধুকে জানিয়ে গিয়েছিলেন শেষ অনুরোধ। ‘মৃত্যুর পর যেন আমার সব চিঠি, লেখা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।’ কিন্তু সেই অনুরোধ পালন করেননি প্রিয় বন্ধু। পরবর্তীকালে সেই লেখাগুলোই এক এক করে সামনে আসতে থাকে আমাদের। এখনও সেই লেখায় মোহিত সমগ্র বিশ্ব। কিন্তু ফ্রানৎজ কাফকা কী ভাবছেন? কেউ কি সত্যিই কথা রাখে না?

বিশ্ব সাহিত্য জগতে একটা কথা বেশ প্রচলিত- ‘কাফকাইস্ক’। সচেতনভাবে কোনো রাস্তা তৈরি করেননি, কিন্তু একটা সময় পর কাফকাকে এভাবেই গ্রহণ করেছিল পৃথিবী। আজও তাঁর লেখা আমাদের ভাবায়। কিন্তু তাঁর জীবন? গ্রেগর সামসার মতোই কি কুঁকড়ে থাকতেন? চারিদিকের পরিবেশ, একাকীত্ব কি আঁকড়ে ধরেছিল ছোটো থেকেই? সংসারের প্রয়োজনে বাবা-মা’কে সবসময়ই ব্যস্ত থাকতে হত। তাঁদের সঙ্গ না পেলেও নিজের তিন বোনের সঙ্গে খেলেই দিন কাটত ছোট্ট কাফকার। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে সেই বোনেরাও মারা যান। বারবার প্রেম এসেছে জীবনে। প্রেমিকা ফেলিস বাউয়ারকে লিখে গেছেন একের পর এক চিঠি। কাফকার ডায়েরির পাতাও সেই জ্বলন্ত অনুভূতির সাক্ষী। কিন্তু কিছুই পরিণতি পায়নি। 

“As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into an enormous insect.”— এইভাবেই শুরু হয়েছিল ‘মেটামরফসিস’। কাফকার বিখ্যাত উপন্যাসের এই একটি লাইন কিংবদন্তির পর্যায় চলে গিয়েছে। কাফকা কি নিজেকেই দেখতে চেয়েছেন বারবার? যক্ষ্মা হবার পর তিনি কি নিজেই সেই পোকা হয়ে যাননি? অবশ্য এই প্রেক্ষাপটেই চলে আসবেন আরও একজন। তিনি ম্যাক্স ব্রড। বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুবাদে যার সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরু কাফকার। নানা বই নিয়ে পরস্পর আলোচনা করেছেন, তর্ক করেছেন, ডুবে গিয়েছেন সেইসবের ভেতর। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকেই বিশ্বাস করে গেছেন কাফকা।

জীবনের শেষ লগ্নে এসে নিজের সমস্ত সৃষ্টি, সব লেখা নষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কেন? এই পৃথিবীর প্রতি তীব্র রাগ? জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা, নাকি অন্য কোনো কারণ? বহুজনের গবেষণার বিষয় এটি। নিজে একটা বড়ো অংশ সত্যিই পুড়িয়ে দেন। বাকিগুলোও পুড়িয়ে ফেলতে অনুরোধ করেন ম্যাক্স ব্রড’কে। যক্ষ্মায় ভুগে ১৯২৪ সালে চিরতরে চলে যান ফ্রানৎজ কাফকা। কিন্তু বন্ধুর অনুরোধ রাখেননি ম্যাক্স। প্রকাশ করে দিয়েছিলেন কাফকার লেখা শেষ উপন্যাস ‘দ্য ট্রায়াল’। এছাড়া আরও বেশ কিছু লেখা প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু সেটা কি ঠিক করলেন তিনি? যুগ যুগ ধরে এই বিতর্কটাই নানা জায়গায় তুলেছেন অনেকে। কাফকা ঠিক কোন মাপের লেখক ছিলেন, তা জানতেন ম্যাক্স ব্রড। তাঁর লেখা প্রকাশ না করলে বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষতি, হয়তো এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু একজন মৃত্যুপথযাত্রী সাহিত্যিকের শেষ ইচ্ছা তো পূরণ হল না! 

একদিক থেকে দেখলে, কাফকার বিশ্বাসই তো ভেঙেছিলেন তিনি। জীবনকালে নিজের লেখাগুলোকে ‘মিসক্যারেজ’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন কাফকা। তাঁর যুক্তি ছিল, এসব লেখা তাহলে সবাইকে ডেকে দেখাব কেন? নিজের জীবনেরই একরকম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিলেন। সেসব কালো অধ্যায়ের কথা কাছের কিছু লোকই জানুক! একটা আগুনে নিজের সঙ্গেই মুছে দিতে চেয়েছিলেন সেই সব ‘সন্তানদের’। কিন্তু তাদেরই একটা অংশকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন ম্যাক্স ব্রড। নিজের বন্ধুকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন তিনি। লেখার মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকুন কাফকা, এটাই কি তাঁর চিন্তা ছিল? বোধহয় তাই… 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সভা-সমিতিতে নয়, বিরলে বসে নিঃশব্দে পড়ার কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন নিশীথ ভড়

More From Author See More