গ্যাব্রিয়েল রোজেনস্টকের কবিতা; মারের সাগর পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন

“No man is good enough to be another man’s master.” - বলেছিলেন ব্রিটিশ লেখক উইলিয়াম মরিস। কথাটিকে এই সময়ের সূত্রে আমাদের সামনে এনেছেন আইরিশ কবি গ্যাব্রিয়েল রোজেনস্টক। এটা ঘটনা যে, অভূতপূর্ব এক সংকটের কেন্দ্রে বসেও, আমরা একটা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন দেখছি সেই আগামীর, যেখানে বাজারের সন্ত্রাস অপসৃয়মান, পুঁজিবাদ তার উদার আলোয়ান গায়ে চাপিয়ে লোকের চোখে আর বেশিদিন জাদুকর হয়ে ধুলো দিতে পারবে না; মানুষ নির্মোহ হবে; নতুন দার্শনিক ভাবনা এসে আশ্রয় হয়ে উঠবে আমাদের পৃথিবীর। আমরা অনেকেই ভাবছি এমন কথা।

গ্যাব্রিয়েলও ভাবছেন; ভাবছেন, এই যে আমরা সকলেই বলছি, পৃথিবীটা আর একইরকম থাকবে না, কীভাবেই-বা তা আলাদা হয়ে উঠবে? তরোয়াল কিংবা লাঠিগুলো কি এবার লাঙলের ফলা হয়ে উঠবে? কে হবে পৃথিবীর শাসক - নাগরিক না বহুজাতিক সংস্থাগুলো? এ-পৃথিবী হয়ে কি উঠবে রাষ্ট্রের বিভাজনহীন গোলোক একটি? ঠিক কীভাবে আলাদা হয়ে উঠবে আমাদের পৃথিবী? অবশ্য, গ্যাব্রিয়েলের আরও প্রশ্ন, এই যে 'আমাদের পৃথিবী' বলে ফেলা হচ্ছে, এ আসলে কাদের পৃথিবী? পৃথিবীর মালিকানা কার? যার হাতে ক্ষমতা আর লাঠি তার? নাকি, যার হাতে সংবাদমাধ্যম? শুধু খবর নয়, এমনকি শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদি সংরূপের অন্তরেও ঠিক কতখানি প্রোপাগান্ডা বাসা বেঁধে আছে? এসবের উত্তরের সন্ধান করতে-করতেই গ্যাব্রিয়েলের কাছে মরিসের উক্তিটি যেন তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কোনও মানুষ-ই আর-একজন মানুষের মানুষের প্রভু হতে পারে না, সে যোগ্যতা তার নেই। নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন যখন আমরা দেখছি, এই বিন্দুটিতেও আমাদের পৌঁছতে হবে যে, এই পৃথিবী কেবল আমাদের নয়। একজনের নয়। এমনকি মানুষের একছত্র মালিকানাধীন-ও নয় এই দুনিয়া।

সম্প্রতি 'দ্য ওয়ার' পোর্টালে গ্যাব্রিয়েল এই লেখাটি লেখেন, নাম দেন -' A Prayer and a Love Poem For Our Stricken World'। আসলে সেটা একটা যুগলবন্দি। এই সংকটকালে কাশ্মীরের শিল্পী মাসুদ হুসেইন তাঁকে কিছু ছবি এঁকে পাঠান। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীটা শিকলে বন্দি। কোথাও আবার কেউ যেন দড়ির ফাঁস আটকে বেঁধে দিচ্ছে পৃথিবীকে। মাসুদের সঙ্গে আগেও রেখায়-লেখায় একটি কাজ করেছিলেন গ্যাব্রিয়েল। কাজের একদম শেষ পর্যায়ে কাশ্মীরে নেমে এসেছিল বন্দিদশা, সরকারি পদক্ষেপে। আবার যখন গোটা পৃথিবীতেই প্রায় অনিবার্য বন্দিত্বের ছায়া, তখন দুই বন্ধু এক হয়েছেন। মাসুদের পাঠানো ছবি দেখে কবিতা লিখেছেন গ্যাব্রিয়েল। সেই যুগলবন্দি আর গ্যাব্রিয়েলের ভাবনা মিলেমিশেই তৈরি হয়েছিল লেখাটি। যেমন, সেখানে একটি কবিতা ছিল এরকম -
‘কবে শিশুর খুশিতে খেলব আবার
বৃষ্টি আর রোদ্দুরে ভিজে
কবে ফের সৈনিক হব নিজে
স্ব-সংক্রমিত ক্ষত নিরাময়ে
কবে উঠব নিজেই নার্স হয়ে।
(when will we chindren play again
in sunshine and in rain
when will we all play soldiers
when will we all play nurses
dressing our self-inflicted wounds)

গ্যাব্রিয়েলের ভাবনাটুকু আমাকে এত আলোড়িত করে যে, তা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেব বলে, তাঁকে মেল করি। বলি, বাংলা ভাষায় কি আমার অক্ষম হাতে তাঁর লেখা অনুবাদ করতে পারি? তিনি অনুমতি দিয়ে জানান, বাংলায় যদি তাঁর লেখা অনূদিত হয়, তবে তাঁর কাছে তা সম্মানেরই হবে। এরপর তিনি তাঁর লেখা একটি হাইকু ও কলকাতায় তাঁর দোসর আলোকচিত্রী দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের তোলা একটি ছবি আমাকে পাঠান। তা পেয়ে সত্যিই অদ্ভুত অনুভূতি হল; হয়তো কেজো দিন হলে, এরকমটা হত না। কিন্তু একটা আরোপিত বন্দিত্ব যখন চলছে, তখন কীভাবে কবিতা ভাবনার জানলাগুলো খুলে দিতে পারে আর পৃথিবীটা ছোটো হয়ে আসে - তা ভেবে শিহরিত হই। এই অবসরে তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সেই কবিতা ও ছবিটি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।
‘what he has loved
and what he has slaughtered…
the butcher's face…’

এইভাবে অনুবাদের চেষ্টা করলাম --

যা সে ভালোবেসেছে
আর, যা করেছে জবাই…
মুখ তার কবেকার— কসাই…

(ছবি – দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)

More From Author See More