ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐক্যরক্ষার বার্তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের জমায়েত রবীন্দ্রসদনে

“এ দেশ সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু কারোর একক সম্পত্তি নয়। এ দেশ সবার।” রবীন্দ্রসদন চত্বরে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির পাদদেশে কবীর সুমন (Kabir Suman) যেন আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন, কাঁপা হাতে আর বুড়োটে গলাতেও র‍্যাপসডি সম্ভব। হাওড়া থেকে রিষড়া, রামনবমীকে কেন্দ্র করে একের পর এক ধর্মীয় হিংসার ঘটনা তাঁকে বিচলিত করেছে। এই হানাহানির পরিস্থিতিতেই গতকাল রবীন্দ্রসদনে একক সভার ডাক দিয়েছিলেন তিনি।

স্বল্প সময়ের মধ্যে এই সভার আয়োজন। কবীর সুমনের আহ্বান পৌঁছানো মাত্র আয়োজনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কবি প্রসূন ভৌমিক। আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন নাট্যকার ও চিন্তক অরূপশঙ্কর মৈত্র, অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দে, সমাজকর্মী বর্ণালী মুখার্জি, আব্দুর রফিক, সদ্ভাবনা মঞ্চের তাহেরুদ্দিন, ভানু সরকার, কল্যাণ সেনগুপ্ত, কীর্তিমান ঘোষ সহ নানা বিশিষ্টজন। গ্রেস চার্চ থেকে এসেছিলেন ফাদার সঞ্জীব। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সমস্ত ধর্মের মানুষ একসঙ্গে এই হানাহানির বিরুদ্ধে সম্প্রীতির বার্তা জানালেন। সমস্ত মত ও পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে তাঁরা ব্যানার তুলে ধরলেন, ‘আমরা ভারতের জনগণ’। এই বাক্য দিয়েই শুরু হয় ভারতের সংবিধান। আর এদিনের সভাও আসলে সেই সংবিধানকে বাঁচিয়ে রাখারই লড়াই।

গত ৩০ মার্চ রামনবমীকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তির খবর আসে। পরবর্তী কয়েকদিনে সেই অশান্তি আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে। তবে এই পরিস্থিতিকে নিছক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে রাজি নন সভায় উপস্থিত কেউই। প্রত্যেকের কথাতেই উঠে এল, ধর্মকে হাতিয়ার করে এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের আশঙ্কা।

সুমন বলছিলেন, “আজকের এই পরিস্থিতিকে জার্মানির ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তুলনা করে দেখাটা ঠিক হবে না। এই সময়কে এই সময়ের দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। সেইমতো কাজ করতে হবে।” তাঁর মতে, “এই কাজটা করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই। আমরা কেবল তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। আঘাতটা ভাগাভাগি করে নিতে পারি।”

অরূপশঙ্কর মৈত্র বলছিলেন, “ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রত্যেকের রাস্তায় নামার সময় এসে গিয়েছে। এরপর দেরি করলে আর কিছুই করার থাকবে না।” তবে সামাজিকভাবে এই আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করা খুব সহজ কাজ নয়, সে-কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি। গ্রেস চার্চের ফাদার সঞ্জীব বলেন, “আমাদের কলমের জোর আর গলার জোরগুলোকে এখন আরেকটু শানিয়ে নিতে হবে। আমরা যে হানাহানি চাই না, একসঙ্গে হাতে হাত রেখে বেঁচে থাকতে চাই, সেটাই জোর গলায় জানিয়ে যেতে হবে সকলকে।”

এদিনের সভার আয়োজক ও সঞ্চালক কবি প্রসূন ভৌমিক বললেন, “রামনবমীকে কেন্দ্র করে এই অশান্তি তো এ-রাজ্যে একেবারে নতুন নয়। ২০১৬ সাল থেকে প্রায় প্রতি বছরই এরকম ঘটনা ঘটছে।” তবে এবারে দেশব্যাপী তার ভয়াবহতা যেন অনেকটাই বেশি। কর্ণাটক, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার সহ সারা দেশে শতাধিক দাঙ্গার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সুমন বলছিলেন, “আমাদের গান্ধীজির মতো এই সমস্ত জায়গায় পৌঁছে যেতে হবে। প্রতিটা জায়গায় বসে থেকে বলতে হবে, আমরা অশান্তি চাই না।” সুমনের কথার সূত্র ধরেই প্রসূন বলছিলেন, “আজকের এই সভা থেকে আমরা শুধু এই অঙ্গীকারটুকুই করতে পারি। আগামীদিনে এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে হারাতে সকলে মিলে মাঠে-ময়দানে ছুটে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

ভারতের সংবিধানকে রক্ষা করা, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রাখার এই বার্তা দিয়েই সভা শেষ হয়। উপস্থিত তরুণরা এগিয়ে আসেন গিটার, মাইক্রোফোন নিয়ে। সমবেত কণ্ঠে তাঁরা গেয়ে ওঠেন ‘রুখে দাও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এই দেশটা জুড়ে’ অথবা ‘রাই জাগো রাই জাগো / ঘরে ঢুকছে কেউটে সাপ, / তোমার ঘুমের সুযোগ নিল / রাম, রুটি, ইনসাফ’। এই হিংসা, অশান্তির বিরুদ্ধে শোনা যায় ভালোবাসার গান, ‘তোমাকে চাই’। সন্ধের অন্ধকারে সেই গান কতটা ছড়িয়ে পড়েছিল, বলা যায় না। তবে এইসব গান মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারটুকু নিয়ে ফিরলেন সকলেই।

Powered by Froala Editor