সমুদ্রের গভীরে জাদুঘর, যেতে হয় ডুবসাঁতারে

ওয়েস্ট ইন্ডিজের নিকটবর্তী ছোট্ট একটি দ্বীপ। গ্রেনাডা (Grenada)। আদা, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল কিংবা রসুন—গ্রেনাডা বিখ্যাত তার রকমারি মশলার জন্য। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মশলার উৎপাদন দেখতে ভিড় জমান ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই দ্বীপে। আর সেই কারণেই গ্রেনাডা হয়ে উঠেছে ‘স্পাইস আইল্যান্ড অফ দ্য ক্যারিবিয়ান’। তবে শুধুমাত্র মশলার উৎপাদন নয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই দ্বীপের নতুন আকর্ষণ হয়ে উঠেছে সমুদ্রগর্ভে অবস্থিত এক বিচিত্র মিউজিয়াম (Underwater Museum)।

হ্যাঁ, মিউজিয়াম, অথচ তা অবস্থিত সমুদ্রগর্ভে! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সমুদ্রগর্ভে প্রত্নসামগ্রী কিংবা চিত্রকলার কীভাবে সংরক্ষণ করা হয় তবে? আর সেটা যদি সম্ভবও হয়, তাহলেও সাধারণ মানুষ সে-সব সামগ্রী দেখবেনই বা কীভাবে? 

সহজ উত্তর, ডুবসাঁতার। হ্যাঁ, জলের তলায় নির্মিত এই আশ্চর্য মিউজিয়ামে হাজির হতে গেলে ডুবসাঁতার দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। স্কুবা ডাইভিং-এর মাধ্যমে সমুদ্রতলের প্রায় ২৬ ফুট নিচে পৌঁছালে তবেই দেখা যাবে আশ্চর্য এইসব প্রত্নসামগ্রী। তাছাড়া কাচের তৈরি নৌকারও ব্যবস্থা রয়েছে গ্রেনাডাতে। তা দিয়েও উপর থেকে দেখা সম্ভব এই আশ্চর্য মিউজিয়াম। তবে বলাই বাহুল্য, সামনে থেকে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার মজা তাতে নেই বললেই চলে। অন্যদিকে এই মিউজিয়ামের দৌলতে বর্তমানে উপার্জনের নতুন পথ খুঁজে স্থানীয় স্কুবা ডাইভার ও ট্রেনাররা।

আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগের কথা। ২০০৪ সাল। ব্রিটিশ-গিয়ানিজ বংশোদ্ভূত ভাস্কর এবং পরিবেশবিদ জেসন ডেকেরেস একক উদ্যোগে গড়ে তোলেন এই ‘আন্ডারওয়াটার’ মিউজিয়াম। অবশ্য তাঁর কথায় এটি মিউজিয়াম নয়, পার্ক। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও প্রকৃতির সংরক্ষণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ তাঁর। আদতে মৎস্য শিকার ও প্লাস্টিক দূষণের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহভাবে বিপদের সম্মুখীন ক্যারিবিয়ান বাস্তুতন্ত্র। ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে সেখানকার প্রবালপ্রাচীর। আর সেই কারণেই এমন উদ্যোগ জেসনের। 

সমুদ্রতল থেকে ২৬ ফুট নিচে ৮০০০ বর্গফুট অঞ্চলজুড়ে তাই এই পার্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। সবমিলিয়ে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে ৭৫টির বেশি ভাস্কর্য। এইসব ভাস্কর্যের মধ্যে দিয়েই সংরক্ষণ এবং ঐক্যের বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হল, শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রেও জেসন নজর রেখেছেন দূষণের দিকে। সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্যগুলি তৈরি করা হয়েছে কংক্রিট, রেবার-সহ এমন কিছু উপাদান দিয়ে, যাদের পিএইচ মাত্রা ৭। অর্থাৎ, তা সমুদ্রের জলে কোনোরকম রাসায়নিক প্রভাব ফেলে না। পাশাপাশি সুনামি, ঘূর্ণিঝড়কে প্রতিরোধী এইসব ভাস্কর্যগুলি। সেখানেই এই মিউজিয়ামের অভিনবত্ব। 

গ্রেনাডার এই সামুদ্রিক পার্কের মডেলকে অনুকরণ করেই পরবর্তীতে ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, মালদ্বীপ, নরওয়ের মতো দেশেও গড়ে উঠেছে এমন মিউজিয়াম। তবে এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সেরা আন্ডারওয়াটার মিউজিয়াম হিসাবে ধরে নেওয়া হয় গ্রেনাডার এই ‘স্কাল্পচার পার্ক’-কে। বছর কয়েক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির প্রকাশিত আধুনিক বিশ্বের ২৫টি আশ্চর্যের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে এই মিউজিয়াম। সবমিলিয়ে জেসনের এই পরিকল্পনা বাস্তবেই একটু একটু করে সচেতনতার বীজ বপন করছে মানব সভ্যতার মননে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More