মহামারী ছড়িয়েই বিশ্বযুদ্ধে বাজিমাত, আমেরিকা ধ্বংসের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা জাপানের

পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কিত একটি অধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ৭০-৮৪ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল যুদ্ধের পটভূমি। সেসব ঘটনার গল্পে হাড়হিম হয়ে যায় এখনও। কিন্তু অনেক তথ্যই প্রকাশ্যে আসেনি। মুছে ফেলা হয়েছে ইচ্ছাকৃত ভাবে। বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি অনেক পরিকল্পনার। সেইসব ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার কথায় শিহরিত হবে যে-কেউ। তেমনই একটি পরিকল্পনা ‘চেরি ব্লসমস অ্যাট নাইট’।

‘অপারেশন চেরি ব্লসমস অ্যাট নাইট’, জাপানের ক্যামিকাল ওয়ারফেয়ার রিসার্চ ডিভিশনের ইউনিট ৭৩১-এর পরিকল্পনা। উদ্দেশ্য ছিল, আমেরিকার জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই জেনোসাইটের জন্য বিউবোনিক প্লেগকেই বেছে নিয়েছিল ইউনিট ৭৩১।

১৯২৫ সালে জেনেভা সম্মেলনে আইনত বন্ধ করা হয়েছিল রাসায়নিক এবং জৈব যুদ্ধনীতি। কিন্তু এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই গোপনে কাজ চালিয়ে যায় জাপান। ১৯৩০ সালে তৈরি হয় জাপান আর্মির নতুন বিভাগ বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ডিভিশন। জন্ম নেয় ইউনিট ৭৩১।

১৯৩০-এর আগেই জাপান চিনের বিস্তীর্ণ অংশের দখল নিয়েছিল। দখল করা মাঞ্চুরিয়া প্রদেশের কাছেই হার্বিনে তৈরি হল গবেষণা কেন্দ্র। ফাঁকা করা হল আটটি গ্রাম। গড়ে উঠল ইউনিট ৭৩১-এর হার্বিন ফেসিলিটি। সেখানেই চিনা অধিবাসীদের উপরে চলত চরম অমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বাদ যেত না মহিলা এবং শিশুরাও।

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম

বায়ুনিরুদ্ধ কক্ষে বন্দি করা হত মানুষকে। তারপর বাড়ানো হত বায়ুর চাপ। দেখা হত কতটা চাপে অক্ষিকোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে চোখ। জীবন্ত মানুষকে ছ’ফুট কাচের জারে জারিত করা হত অ্যাসিডে। কখনো পৃথক পৃথক জারে আলাদা করে কেটে রাখা হত হাত, পা, মাথা। বেলজারের গায়ে লেখা থাকত ব্যক্তির নাম।

আরও পড়ুন
সম্মান পাননি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভারতীয় সেনারা, ক্ষমাপ্রার্থনা ব্রিটেনের

১৯৩৭ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় চিন-জাপান যুদ্ধ। যুদ্ধের কাজে জৈবঅস্ত্রের ব্যবহার শুরু করে ইউনিট ৭৩১। হার্বিন ফেসিলিটিতে যুদ্ধবন্দি চিনাদের ওপরে প্রয়োগ করা হতে লাগল কলেরা, বসন্ত, প্লেগের জীবাণু।

আরও পড়ুন
ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্বে বিভক্ত পৃথিবী, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত?

১৯৪০-এ চিনের ওপর গুরুতর আঘাত হানে জাপান। চিনের পূর্ব এবং উত্তর-মধ্য প্রদেশে বোমাবর্ষণ করে জাপানের বোমারু বিমান। ওই বোমে ব্যবহৃত হয় ‘র্যা স্ট ফ্লি’ নামক এক ধরণের মাছি। এই মাছিগুলোর মাধ্যমেই চিনে ছড়িয়ে পড়ে বিউবোনিক প্লেগ। মহামারীর আতঙ্কে বন্ধ করা হল স্কুল, দোকানপাট। গৃহবন্দি করা হয় মানুষকেও। কিন্তু ক্রমাগত বোমাবর্ষণে প্রাণ বাঁচাতে, পালাতে শুরু করে লোকজন। তাতে আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেয় প্লেগ। ২০০২-এর একটি গবেষণা অনুযায়ী, চিনে সাড়ে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল এই জৈবযুদ্ধে।

এর ঠিক বছর খানেক পরে, পার্ল হার্বার আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপানের বিরুদ্ধে। চিন-জাপান যুদ্ধে জৈব অস্ত্রের সফলতাকে মাথায় রেখেই একাধিক ছক কষে জাপান। তবে একের পর এক ব্যর্থ হতে থাকে সমস্ত চেষ্টাই। অন্যদিকে এই সময় জার্মানি আত্মসমর্পণ করে রাশিয়ার কাছে। তবে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় জাপান। বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বড় আঘাতের মাধ্যমেই শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার ফন্দি তৈরি হয়।

বৃহত্তর এই পরিকল্পনা করেন ইউনিট ৭৩১ এর জেনারেল, তোশিমি মিজোবুচি। সঙ্গে ছিলেন আরেক মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং জেনারেল শিরো ইসি। পরিকল্পিত এই আক্রমণের নাম দেওয়া হয় ‘অপেরাশন চেরি ব্লসমস অ্যাট নাইট’। ঠিক করা হয়, ৫০০ সৈন্যের ২০টি কোম্পানি, বিমান পরিবহনে সক্ষম আই-৪০০ সাবমেরিনে রওনা দেবে ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে। উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে, সেখান থেকেই বিমানে আক্রমণ করা হবে আমেরিকার মূল ভূভাগে।

প্লেগের জীবাণু সংক্রমিত সহস্রাধিক ফ্লি-যুক্ত বোমা নিক্ষেপ করা হবে সান দিয়েগোতে। সেই সঙ্গে আমেরিকায় আত্মঘাতী হবে প্লেগ-আক্রান্ত পদাতিক সৈন্যরাও। এই অভিযানের নেতৃত্ব বর্তায় জেনারেল ইশিও ওবাটার উপরে। ঠিক করা হয়, ২২ সেপ্টেম্বর আঘাত করা হবে আমেরিকায়।

সায় ছিল না জাপানি নৌবাহিনীর। যুদ্ধের পরিণতি অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। আক্রমণের বদলে জাপানের মূল্যবান দ্বীপগুলির প্রতিরক্ষায় জোর দিতে চেয়েছিল নেভি। একাধিকবার প্রতিবাদ করেন নেভি জেনারেল হিদেকি তোজো। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ় ছিলেন শিরো ইশি।

এরই মধ্যে নতুন যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারে পৃথিবীকে চমকে দেয় আমেরিকা। ৬ আগস্ট হিরোশিমা কার্যত মুছে যায় পারমাণবিক বোমায়। আমেরিকার এই অতর্কিত আক্রমণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে জাপানে। জাপানের জৈব-গণহত্যার পরিকল্পনা প্রকাশ পেলে বাড়তে পারে আমেরিকার প্রতিশোধস্পৃহা। এমনটাই আশঙ্কা তৈরি হয় জাপানে। অত্যন্ত দ্রুততায় ৯ আগস্টের মধ্যেই লোপাট করা হয় চেরি ব্লসমসের সমস্ত প্রমাণ এবং নথি।

১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের পর বন্দি হন হিদেকি, শিরো, ওবাটা-সহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিকেরা। প্রাণে বাঁচার জন্য, আমেরিকাকে এই পরিকল্পনার নকশা হস্তান্তর করে শিরোন। তবে প্রাণঘাতী এই মারণ অস্ত্রের কথা সেভাবে প্রকাশ্যে আনেনি আমেরিকাও।

সৌভাগ্যবশত বাস্তবায়িত হয়নি অপারেশন চেরি ব্লসমস। জাপানের এই আক্রমণ ফলপ্রসূ হলে, প্রাণ যেত বহু মানুষের। হয়তো হিরোশিমা-নাগাসাকির মতোই কোনো বিভীষিকা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হত আমেরিকাকে। হয়তো বদলে যেত আজকের ইতিহাসও…

Powered by Froala Editor

More From Author See More