ভারত ও ইতালীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন কলকাতায়, নেপথ্যে মিয়া লেকোমতে

মঞ্চজুড়ে অদ্ভুত আলো-আঁধারের খেলা। আর এই আবহাওয়াকে আরও মাতাল করে তুলেছে স্যাক্সোফোন এবং অ্যাকর্ডিয়ানের সুর। এমন রোমহর্ষক, টান-টান উত্তেজনাময় মঞ্চের উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শিল্পীরা। নাচছেন, গান গাইছেন। তাঁদের শব্দবাণ ছিটকে আসছে দর্শকদের দিকে। তবে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না কাউকেই। শুধুমাত্র মঞ্চে ঝোলানো সাদা পর্দার ওপর অনবরত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলছে তাঁদের ছায়া। 

ভাবছেন, এ বুঝি কোনো নাটকের দৃশ্যের বর্ণনা। না, তা একেবারেই নয়। বরং, যদি বলি কবিতাপাঠ? অবাক হবেন অনেকেই। এভাবেও যে কবিতার উপস্থাপন হতে পারে, তা আমাদের পক্ষে ভাবাটা একটু অসম্ভবই বটে। কবিতার পাঠই হোক কিংবা আবৃত্তি— আসলে চিরকালই আমরা কবিতার ব্যাপারে আমরা একটু বেশি সিরিয়াস। আমরা আদৌ কি কবিতার উদযাপন করেছি কখনও? বোধ হয় না। তবে নাচ, গান, কখনও আবার নানান শিল্পকলার মধ্যে দিয়েই এভাবে কবিতার উদযাপন চলে ইতালিতে। যার নেপথ্যে রয়েছেন ফরাসি-ইতালীয় কবি মিয়া লেকোমতে (Mia Lecomte)। আগামী ১০-১২ জুন ‘ভাষা সংসদ’ এবং ‘অ্যান্টোনিম’-এর যৌথ উদ্যোগে কলকাতায় আয়োজিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক অনুবাদ কবিতার উৎসব ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’ (Kolkata Poetry Confluence)। আর সেই মঞ্চেই প্রথমবার ভারতে উপস্থাপিত হবে এই বিচিত্র ‘কবিতা উদযাপন’। 

পিছিয়ে যাওয়া যাক বেশ কয়েকটা বছর। প্রথম দশকের শেষের দিক সেটা। ২০০৯ সালের গ্রীষ্মে মিয়া লেকোমতের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছিল ‘কমপানিয়া দেলা পোয়েটে’। আক্ষরিক অর্থেই যার মানে ‘কবি সঙ্গ’। হ্যাঁ, ইতালি ভাষার একদল মহিলা কবিকে এক ছাদের তলায় নিয়ে এসেছিলেন লেকোমতে। যার মধ্যে রয়েছেন প্রিসকা আগুস্তোনি (সুইস-ব্রাজিল), ক্রিস্টিনা আলি ফারাহ (সোমালিয়া-ইতালি), আনা বেলোজোরোভিচ (রাশিয়া-পর্তুগাল), লিভিয়া বাজু (রোমানিয়া), লরে ক্যাম্বাউ (ফ্রান্স), আদ্রিয়ানা ল্যাংট্রি (আর্জেন্টিনা), সারা জুহরা লুকানিক (ক্রোয়েশিয়া), ভেরা লুসিয়া ডি অলিভেরা (ব্রাজিল), হেলেন পারাসকেভা (গ্রিস), ব্রেন্ডা পোরস্টার (ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্র), বেগোনিয়া পোজো (স্পেন), বারবারা পুমহোসেল (অস্ট্রিয়া), ফ্রান্সিসকা পাজ রোজাস (আর্জেন্টিনা), ক্যান্ডেলারিয়া রোমেরো (আর্জেন্টিনা-সুইডেন), বারবারা সেরদাকোস্কি (পোল্যান্ড-মারোক্কো-কানাডা), জ্যাকলিন স্পাকিনি (ফ্রান্স-ইতালি), ইভা টেলর (জার্মানি)। আশ্চর্যের বিষয়, এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই যোগ রয়েছে অভিবাসনের। কারোর জন্ম ইতালিতে, আবার কেউ ইতালীয় বংশোদ্ভূতা। প্রচলিত কবিতাপাঠ ও রচনা ছেড়ে ভিন্নপথের অনুসন্ধানে নামেন তাঁরা। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণ কী?

“কবিতা একটি জীবন্ত শিল্পমাধ্যম। তারও শরীর আছে, অভিব্যক্তি আছে। অনায়াসেই দেশ, কাল, ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারে সে। তাই আমরা, কমপানিয়ার বন্ধুরা ঠিক করেছিলাম, শুধু পড়া নয়, কবিতাকে অন্যভাবে উপস্থাপন করতে হবে।”

আরও পড়ুন
গানের মাধ্যমেই সংবাদপ্রেরণ, ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এ খোঁজ হারানো লোকশিল্পের

বলছিলেন লেকোমতে। কবিতা উপস্থাপনার শুরুটা হয়েছিল গান ও নাচের মাধ্যমেই। তবে তার জন্য বিশেষ কোনো পরিকল্পনা ছিল না কারোরই। লেকোমতের কথায়, “সবটাই এসেছিল খুব সাবলীলভাবে। আসলে কবিতার স্বার্থেই আমাদের একত্রিত হওয়া। পরবর্তীতে ভাস্কর, যন্ত্রবাদক, চিত্রশিল্পীরাও একে একে যোগ দেন আমাদের সঙ্গে।” সেদিক থেকে এই সংগঠনকে অনায়াসেই ‘কবিতা-পরিবার’ বলা চলে। কবিতার সমস্ত উপাদানই যেন মজুত সেখানে। জানা গেল, প্রতিটি মঞ্চ উপস্থাপনার আগে সমস্ত শিল্পীরা একইসঙ্গে সপ্তাহখানেক কাটান একটি বাড়িতে। চলে অনুশীলন, আলোচনা-পর্যালোচনা। 

আরও পড়ুন
ভারতে এই প্রথম কবিতা উপস্থাপনা ইকারো ভালদেরামার, নেপথ্যে কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স

তবে কলকাতার মঞ্চে ‘কমপানিয়া’-র অনুষ্ঠানটা একটু অন্যরকম হবে। মিয়া লেকোমতে এলেও, এবার সঙ্গে থাকছেন না তাঁর শিল্পীবন্ধুরা। বরং, তাঁর সঙ্গ দেবেন চার ভারতীয় মহিলা কবি। থাকবেন ঝিলম ত্রিবেদী, ঘুংঘরু পারমার, নিশি পুলুগারথা এবং বিতস্তা ঘোষাল। মাত্র কয়েকদিনের অনুশীলনে ভাষার বেড়াজাল ভেঙে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ভাষাগোত্রের কবিতার সংমিশ্রণ— এও তো এক বিচিত্র নিরীক্ষা। এই পরীক্ষামূলক সাহিত্যচর্চার জায়গাটাই কি ক্রমশ এড়িয়ে যাচ্ছেন বাঙালি কবিতাপ্রেমীরা? নাকি সাহিত্যের প্রথাগত ফর্মটাকেই আঁকড়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব? 

আরও পড়ুন
অনুবাদ কবিতার মহোৎসব, ঐতিহাসিক ‘পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এর সাক্ষী হতে চলেছে কলকাতা

উত্তরে লেকোমতে জানালেন, “এক্সপেরিমেন্টেশনের সঙ্গে ইতালি এবং ইউরোপের এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে। আমার মনে হয় বর্তমান সময়ে তার পরিসর আরও বৃদ্ধি পাওয়া উচিত।” উঠে এল অনুবাদ কবিতার প্রসঙ্গও। মিয়া জানালেন, “অনুবাদ করার অর্থ শুধু ভাষান্তর করা নয়। অন্য কবির ভাষা, বাচনভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনাকে অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে না ধরতে পারলে, সেই ভাষান্তরের কোনো অর্থ থাকে না। খেয়াল রাখতে হবে, দুটি ভাষাতেই সংশ্লিষ্ট কবিতাটা যেন একটি সাধারণ জগৎ খুঁজে পেতে পারে।” কমপানিয়া সেই চেষ্টাটাই যেন করে চলেছে বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে। কবি ও কবিতাপ্রেমীদের মধ্যে একটি সাধারণ জগৎ গড়ে তুলছে এই সংগঠন। 

এই কথার সূত্রেই উঠে এল অভিবাসন, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি, হিংসা-প্রতিহিংসা যুদ্ধের কথা। অন্যদিকে কমপানিয়ার প্রায় সমস্ত সদস্যাদের সঙ্গেই যোগ রয়েছে অভিবাসনের। সেদিক থেকে, বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি ঘিরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী কী? খানিক চিন্তিত হয়েই তিনি জানালেন, “আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কেউ জানি না। এই মুহূর্তে সাহিত্যচর্চায় তুলে আনতে হবে আমাদের কথা। বুঝতে এবং বোঝাতে হবে, আমরা আদতে কী।”

তবে কলকাতায় আয়োজিত এই অনুবাদ কবিতার মহোৎসবে যোগদান নিয়ে তাঁর উত্তেজনায় অভাব নেই এতটুকু। ইতালি এবং ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল বহু শতাব্দী আগেই। এবার তিনিই যে হয়ে উঠছেন এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে অন্যতম সেতু। খানিক হেসে ইতালীয় কবি জানালেন, “কবিতাই একমাত্র এটা সম্ভব করতে পারে…” সবমিলিয়ে কলকাতার মঞ্চ এবং কমপানিয়ার চতুর্থ প্রযোজনা ‘এ হোম আউটসাইড’ যেন নতুন ইতিহাস লিখতে চলেছে বাংলার বুকে…

Powered by Froala Editor