স্বরলিপিতে 'বাঁচিয়েছেন' কান্তগীতিকে, প্রয়াত রজনীকান্ত-দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়

‘আমি মন্ত্র-তন্ত্র কিছু জানিনে মা’— কলকাতা তো বটেই, কালীপুজোর আবহে গোটা বাংলা জুড়েই পাড়ায় পাড়ায় অনুরণিত হয় পান্নালালের গাওয়া এই কিংবদন্তি গান। কিন্তু এই গানের সুরকার কে? কে-ই বা লিখেছিলেন এই গানের কথা? অনেকের কাছেই জানা নেই এই উত্তর। 

দিলীপকুমার রায়। না, ইনি দ্বিজেন্দ্রপুত্র নন। তবে বংশগৌরবে এতটুকু পিছিয়ে নেই তিনিও। কান্তকবি তথা রজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র দিলীপকুমার। শুধু কান্তকবির গানের সুর-সংরক্ষণই নয়, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বাংলা গানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। তাঁর কাছে গানের পাঠ নিয়েছেন বাংলার খ্যাতনামা শিল্পীরা। যে তালিকায় রয়েছেন হেমন্ত, সন্ধ্যা, পান্নালাল কিংবা অর্ঘ্য সেনের মতো নাম। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন প্রবীণ সঙ্গীত বিশারদ। গতকাল ১০৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হল বাংলা গানের এক বর্ণময় অধ্যায়।

রজনীকান্তের জ্যেষ্ঠ কন্যা শান্তিলতা রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র দিলীপকুমার। জন্ম ১৯১৭ সালে। অর্থাৎ, ‘দাদামশাই’ রজনীকান্তকে চোখে দেখার সুযোগ হয়নি তাঁর। সবমিলিয়ে প্রায় ২৯০টি গান লিখেছিলেন রজনীকান্ত। সুর দিয়েছিলেন নিজেই। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেইসব গান তুলিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের। মা এবং মামাদের কাছ থেকে এইসকল গানের পাঠ নেন দিলীপকুমার। সেই গানের সূত্র ধরেই দাদামশাই-এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। 

তবে গানকেই যে পেশা করে নেবেন, কৈশোরে এমনটা কোনোদিনই ভাবেননি তিনি। বাবা ছিলেন রসায়নবিদ। ১৯৩৮ সালে সিটি কলেজ থেকে পাশ করার পর বাবার ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন দিলীপকুমার। সঙ্গে শুরু হয় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষকতা। প্রায় একই সময়ে মামার হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে সঙ্গীতের দুনিয়ায় পা রাখা তাঁর। মামা সুকৃতি সেন ছিলেন তৎকালীন খ্যাতনামা রেকর্ড কোম্পানি ‘সোনেলা’-র ট্রেনার। গান রেকর্ড করার প্রস্তাব দেন তিনিই। সুকৃতি সেনের কথা এবং সুরেই প্রথম দুটি গান রেকর্ড করেন দিলীপকুমার। ১৯৩৮ সালের পুজোয় যা প্রকাশ পেয়ে ভিনাইল হিসাবে। 

চল্লিশের দশকে এই রেকর্ডের সূত্রেই রেডিও এবং গ্রামোফোন কোম্পানিতে নিয়মিত যাতায়াত গড়ে ওঠে দিলীপকুমারের। আকাশবাণীতে প্রায়ই আধুনিক গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তিনি। অনুপম ভট্টাচার্য, সমরেশ চৌধুরী, বীরেন ভট্টাচার্য, নজরুল ইসলামের কথা ও সুরেও গেয়েছেন একাধিক গান। এমনকি স্বয়ং তাঁকে গানের পাঠ দিয়েছেন কাজী নজরুল। 

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। দেশেও আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। ব্যারিটোন গলার কারণে নানান জায়গা থেকে ডাক আসতে শুরু করে তাঁর কাছে। মাইকে গান গাইতে হবে তাঁকে। রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ কিংবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, গীতিনাট্য— মঞ্চে উঠে বহুবার এইসব গানে গলা মিলিয়েছেন দিলীপকুমার। ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট রাতেও সারারাত তাঁর গলায় ঝরেছিল ‘বলো বলো বলো সবে’, ‘মোর দেশ জাগল এবার’ কিংবা ‘যেদিন সুনীল জলধি হতে’-এর মতো গান। 

স্বাধীনতার পর ১৯৫০-এর দশকে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানিতে রেকর্ড ট্রেনার হিসাবে কাজ শুরু করেন দিলীপবাবু। হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতনামা সঙ্গীত তারকাদের মাস্টারমশাই। হেমন্ত থেকে শুরু করে সন্ধ্যা কিংবা অনুপ ঘোষাল, সন্তোষ সেনগুপ্তের মতো তারকারাও পাঠ নিয়েছেন তাঁর কাছে। তাছাড়াও বাংলাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর অগণিত শিষ্য। তবে ৫০-এর দশকের পর নিজের কণ্ঠে সেভাবে আর কোনো রেকর্ডই করেননি দিলীপবাবু। 

বলতে গেলে, হারিয়ে যেতে বসা অতুলপ্রসাদী ও কান্তগীতিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনিই। অনুভব করেন, বাণিজ্যিক জগতে ক্রমশ সুর-বিকৃতি হয়ে চলেছে কান্তগীতির। রজনীকান্তের তৈরি করা মূল সুর-সংরক্ষণের জন্য স্মৃতির ওপর ভিত্তি করেই একাধিক কান্তগীতির স্বরলিপি তৈরি করেন দিলীপকুমার। প্রথমে জিজ্ঞাসা প্রকাশনী ও পরে রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমি থেকে ‘কান্তগীত-লিপি’ নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় এই স্বরলিপিগুলি। যা আজও হাজার হাজার সঙ্গীত শিক্ষার্থীর পাথেয়। একশোর গণ্ডি পেরিয়েও গানের সঙ্গে অটুট ছিল মাস্টারমশাই-এর সম্পর্ক। শিক্ষার্থীদের আনাগোনা যেমন লেগে থাকত, তেমনই চলত সঙ্গীতচর্চাও। সেদিক থেকে একশো পেরিয়েও চিরতরুণ ছিলেন রজনী-দৌহিত্র। এমন এক বর্ণময় ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে এবার শেষ হল চলমান সঙ্গীত-ইতিহাসের একট অধ্যায়। অভিভাবক হারাল বাংলা সঙ্গীতজগৎ…

তথ্যসূত্রঃ
১. ‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে’, শ্রুতি গোস্বামী, প্রহর.ইন
২. ১০৫টি বসন্ত পেরিয়ে বাংলার ‘কান্তগীতি’ আগলে বেঁচে আছেন দিলীপকুমার রায়, বঙ্গদর্শন
৩. Mastermoshai Dilip Kumar Roy passes way at 105, TelegraphIndia

Powered by Froala Editor