১৫৮৫-র বন্যা থেকে ১৮৯৭-এর ভূমিকম্প – দুর্যোগ কাটিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন

সুন্দরবন— জায়গাটার নাম শুনলেই কেমন রোমাঞ্চ আসে না! বাঘ, কুমিরের এই দেশে না জানি কত আশ্চর্য রয়েছে। ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, জালের মতো বয়ে যাচ্ছে নদী, খাল; তার মধ্যেই বসবাস করছে মানুষ। শহরের মতো অত স্বাচ্ছন্দ্য হয়তো নেই, কিন্তু রয়েছে লড়াইয়ের শক্তি। আমফান, আয়লা, ফণী— এই নামগুলো এই অঞ্চলের কাছে বিভীষিকা তো বটেই। কিন্তু যুগে যুগে এখান থেকেই বেঁচে ফিরেছে এই বাদাবনের দেশ। তবে যে নামগুলো করলাম, সেসবই সাম্প্রতিক দুর্যোগ। সুন্দরবনের লড়াইয়ের কাহিনি কি আজকের? সেই কবে থেকে প্রকৃতির চোখ রাঙানির সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে এখানকার বাসিন্দারা। ইতিহাসও তো কথা বলে!

আজকের একবিংশ শতকে, যত অভাব অভিযোগ থাকুক না কেন, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের কারণে দুর্যোগের একটা আভাস পাওয়া যায়। আজ থেকে একশো বা দুশো বছর আগের সুন্দরবনের মতো অত দুর্গমও নয় এখন। তাও এমন পরিস্থিতিতে একটু ইতিহাসের দিকে নজর রাখা যাক। দেখা যাক সুন্দরবনের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। 

আজকে সুন্দরবন অঞ্চলের যে রূপ দেখছি, একসময় তা এরকম ছিল না। যুগে যুগে রূপ বদলেছে এই অঞ্চল। কখনও জাগে, কখনও নিভে যায়। তার ওপর এখন তো কাঁটাতারও চলে গেছে এর ওপর দিয়ে। যাই হোক, এই বাড়া-কমার ঘটনা সেই প্রাচীন সময় থেকেই হয়ে আসছে। একে সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চল, জলে ঢেকে আছে জায়গা; তার ওপর কাদা মাটি। একটু কিছু হলেই নেমে যায় অঞ্চল। আর নামলেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে থাকে নদী-সমুদ্রের জল। ফলে অনেক জায়গা ধ্বংস হয়। বিগত কয়েক দশকে এমন ঘটনা প্রচুর হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে বন্যা। যা প্রায় নিত্যসঙ্গী সুন্দরবনের। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ; দিল্লির মসনদে তখন বসে আছেন বাদশাহ আকবর। সুন্দরবনের অবস্থা ঠিক কীরকম ছিল, আন্দাজ করা যায়। এমন সময় একদিন সমুদ্রের জল বেড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জল ঢুকে ভাসিয়ে দিল সমস্ত জায়গা। তার ওপর ঝড়-বৃষ্টি, যা চলেছিল পাঁচ ঘণ্টার ওপর। নৌকা, জাহাজ, গ্রাম সব ধ্বংস হয়ে যায়; সঙ্গে মারা যায় দুই লাখের কাছাকাছি লোক।

প্রায় একই জিনিস ঘটে খুলনার দক্ষিণের সুন্দরবনেও। কিন্তু সমুদ্রের ধারে যখন বাস, চারিদিকে ঘন জঙ্গল, এসব তো লেগেই থাকবে। কিন্তু কখন যে আঘাত নেমে আসবে সেটা তো বলা যাচ্ছে না! যেমন ১৬৮৮ সালের একটি ঝড় আবারও নেমে আসে সুন্দরবনের ওপর। এবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় সাগরদ্বীপের। এক ধাক্কায় প্রায় ৬০ হাজার জনের প্রাণ নিয়ে চলে যায় এই ঝড়। এরই কয়েক বছর পর, ১৭০৭ সালে ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে হাজির হয় একটি সাইক্লোন। বুঝতেই পারছেন, কী অবস্থা হয়েছিল। এক ধাক্কায় বহু অঞ্চল চলে যায় জলের নিচে। অনেক জায়গা, ছোটো দ্বীপ ডুবে যায় জলের তলায়। এরপর যত সময় যেতে থাকে, ঝড়ের চরিত্র ভয়াল থেকে ভয়ালতর হতে থাকে। ১৮৬২, ১৮৬৪, ১৮৬৭— পরপর সময় ঘটে যায় আরও বেশ কিছু দুর্যোগ। ভাবতে অবাক লাগে, কী করে তখনকার দিনের মানুষরা লড়াই করেছিল এর সঙ্গে? কেমন করেই বা সাহস সঞ্চয় করেছিল, ভেবেছিল যে একদিন আবার উঠে দাঁড়াব? 

তবে এর কাছাকাছি সময়ের দুটো ঝড়ের কথা বলা দরকার। ১৮৭৬ সালের প্লাবন ও ঝড়ের বিস্তার এবং ভয়াবহতা অনেক মাত্রাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সন্দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ থেকে বরিশাল পর্যন্ত এর প্রভাব ছিল। শুধু বাখরগঞ্জ আর নোয়াখালিতেই দশ লক্ষ লোক গৃহশূন্য হয়। এখানেও মারা যায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। তবে মনে করা হয়, এই সংখ্যাটা অনেকটা বেশি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই চলে আসে ১৯০৯ সালের ১৭ অক্টোবর। খুলনাকে রীতিমতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই সাইক্লোন। এই দুই ঝড়ের ক্ষতির রেশ বহুদিন পর্যন্ত ছিল। 

তবে এ তো গেল ঝড়ের কথা। এখানেই থেমে নেই। ঝড়ের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে হাজির হয় ভূমিকম্প। আর সুন্দরবন অঞ্চলে এর ফলে ক্ষতির মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নরম মাটি বসে গিয়ে প্রায় বন্যাই শুরু হয়ে যায়। যেমন ১৭৩৭ সাল। পলাশির যুদ্ধ তখনও হয়নি বটে; কিন্তু ইংরেজরা ভালোভাবেই নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। সেই সময়ই শুরু হয় প্রবল ভূমিকম্প, সঙ্গে ঝড়। শুধু সুন্দরবন নয়; এর রেশ পৌঁছেছিল কলকাতা-হুগলি পর্যন্ত। কারখানাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মারাত্মকভাবে। আর সুন্দরবন? ইতিহাস বলে, প্রায় জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল এরপর। শুধু ছিল মৃত্যুর হাহাকার। এর পরেই আরও একটি ভূমিকম্প আসে ১৭৬২ সালে। সুন্দরবন এক ধাক্কায় আরও কিছুটা ছোটো হয়ে যায়। এমনকি, কলকাতার পাশে গঙ্গার জলস্তরও ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল। 

আর দুটো ভূমিকম্পের কথা বলে দুর্যোগের অধ্যায় শেষ করব। প্রথমটি ১৮৪২ সালের; মনে করা হয় এর অকুস্থল বাংলাতেই ছিল। প্রায় আফগানিস্তান পর্যন্ত কম্পন অনুভূত হয়েছিল। এর পরেরটি হয়েছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন। এবারও বিস্তার ছিল প্রায় সিকিম, আসাম পর্যন্ত। আর দুবারেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সুন্দরবন। ভু-প্রকৃতিগত পরিবর্তনও হয়েছিল; যা এখনও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বাদাবন। 

এইভাবেই যুগ যুগ ধরে নানা আঘাতেও টিকে আছে আমাদের সুন্দরবন। সুন্দরী, গরানের দেশে আজও হাত ধরাধরি করে বাঁচার মুখ দেখছে এঁরা। এত ঝড়, এত বিপর্যয়— তবুও হাল ছাড়েনি কেউ। মাটি আঁকড়ে ধরে বাঁচার রাস্তায় ফিরেছে সুন্দরবন। একটা আমফান কি এত সহজে শেষ করে দেবে একে? সব জায়গা মিলিয়ে যাবে, হয়ত আবারও কিছু জায়গা চলে যাবে সাগরের তলায়। এর পাশেই বাঁচার জন্য উঠে দাঁড়াবে সুন্দরবনবাসী। বাড়িয়ে দেবে নিজের নিজের শ্বাসমূল। এবার আবার তৈরি করার সময়, এগিয়ে যাবার সময়… 

তথ্যঋণ- যশোহর-খুলনার ইতিহাস, প্রথম খণ্ড/ সতীশচন্দ্র মিত্র

Powered by Froala Editor

More From Author See More