ঘন বাঁশবন। নিচে বাঁধা ছোটো ডিঙি। ডিঙির ভেতর পুঁইশাকের আঁটি। খেপলা জাল। দুটো কইমাছ। প্রকাণ্ড এক দাঁড়াশ সাপ। ছাইছাই রং। সবমিলিয়ে ভাসছে। ভাসতে ভাসতে অর্জুন-ছাতিম-তেঁতুলের প্রেতচ্ছায়া। যে ছায়া থেকে অবলীলায় ঝুলে পড়তে পারে কোনো কেউটে। এমন সময় যেন ইন্দ্রনাথ বলে ওঠে, কী রে শ্রীকান্ত ভয় করে?
ভয় করে। আঠেরোশো বাষট্টি সালে, কলকাতা-কুষ্টিয়া রেলপথ স্থাপিত হওয়ার পরেও, ইছাপুর (Ichhapur), হুগলি নদীর পুবদিকের নির্জন নিশ্চুপ গ্রাম। তারও দক্ষিণ-পূর্বদিকে—বিস্তারিত গাছপালা, শেয়াল এবং দুর্ধর্ষ সাপ, বৃষ্টি এবং হুগলি নদীর জলে পুষ্টি পেয়ে জন্ম হয়েছে এক বিলের—বরতি বিল, দীর্ঘ আট কিলোমিটার জলবহনের পরে ইছাপুর খাল যেখানে এসে মিশেছে। আজ্ঞে হ্যাঁ, মোহনা থেকেই ইছাপুর খালের জলকথা শুরু হয়েছে। এবার কচুরিপানা ঠেলে ঠেলে উৎসমুখে বয়ে যাওয়া যাক!
ইতিহাসবিদ এবং সংখ্যাতত্ত্ববিদ উইলিয়াম উইলসন হান্টার, ১৮৭৫ সালে তাঁর ‘আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অফ বেঙ্গল’-এর প্রথম খণ্ডে লিখছেন: ‘The Ichhapur Khal, runs from the Hugli at Ichhapur into Bartii bil; five miles in length, and navigable throughout the year.’ নদীতে মালবোঝাই নৌকো আসে, ভাসে খালের জলে, সদ্যোজাত জনপদের মধ্যে ঢুকে যায়। বর্তমানে ডিঙি ভাসে, তাও মোহনার কাছাকাছি, কয়রাপুরে। কুমড়ো-লাউ-এঁচোড়-কলমিশাক-ঝিঙে-পটলবোঝাই একেকটা ডিঙি, বরতির বিল-ফেরত এসে ঠেকে কয়রাপুর হাটে। আমতলা, শান্তিনগর, পলতা, বাদামতলা এমনকি নবাবগঞ্জের বাজারগুলোকেও সবজিসঞ্চার করে কয়রাপুর হাট। যেহেতু নিজস্ব ডিঙি এবং নিজস্ব শ্রমেই খাল বেয়ে যাতায়াত করেন চাষিরা, তাই সবজির দাম এই হাটে তুলনামূলক কম।
আরও পড়ুন
ফেলে দেওয়া জিনিসের পসরা, চব্বিশ পরগনার ‘ভাঙ্গা মেলা’ ও চৈতন্যের স্মৃতি
যে-কোনো খালের অতীত আর বর্তমানজুড়ে কি কেবলই পরিবহণ? ইছাপুর খালের জল আর নরম পলিমাটি পেয়ে, খালের দু-ধারে আস্তানা গেড়েছিলেন কিছু মৃৎশিল্পী—অধিকাংশই জল-মাটিতে মিশে গেলেও, দু-একঘর মৃৎশিল্পীর আজও দেখা পাওয়া যায় বৈকি। এবং মৎস্যজীবীদের ঠাঁই অবশ্যম্ভাবী। সেই মৎস্যজীবীদের সংখ্যা ইছাপুরের কেন্দ্রে ক্রমে ক্রমে কমেছে, পরিধির দিকে এগোলে তাঁদের দেখাটেখা পাওয়া যায়। খালের মধ্যেই, ইতিউতি, বাঁশ বেঁধে একটা আয়তাকার ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছেন তাঁরা। দুই পাড়ের যে-কোনো একদিকে, জল থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে বাঁশ দিয়েই বাঁধা হয়েছে দুজন মানুষের বসবার মতো জায়গা, ওপরে নৌকোর ছই, নিচে খেপলা জাল। রোদ-ঝড়-জলে অনায়াসে মাছ ধরার উত্তম ব্যবস্থা, নাম: ভাসাল্।
আরও পড়ুন
নবদ্বীপ ও কলকাতায় গুরু নানক, দেখা হয়েছিল চৈতন্যের সঙ্গেও!
এরপরেই ইছাপুর খালের ওপর একটা লকগেট। আর এগনো যাবে না। অগত্যা একটা লাফ মারতেই হবে।
আরও পড়ুন
চৈতন্য এই ঘনকালো, হাত-পা কাটা জগন্নাথের বুকের ভিতরেই মিলিয়ে গিয়েছিলেন?
আঠাশে এপ্রিল। ১৭৭৮। শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মধ্যে এমন এক চুক্তি হয়, ইতিহাসে যে-চুক্তির গালভরা কোনো নাম নেই। কেমন সেই চুক্তি? শ্যামবাজার এবং বাগবাজারের বেশ কিছু জমির বিনিময়ে রাজা নবকৃষ্ণের থেকে ইছাপুর-নবাবগঞ্জ—এই সম্পূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা হস্তান্তরিত হয়ে পৌঁছয় ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির জিম্মায়। একধারে হুগলি নদী, মাঝখানে ইছাপুর খাল—কম্পানির এজেন্ট জন ফারকুহার এখানেই গড়ে তুললেন বারুদ তৈরির কারখানা। ১৭৯১। ইতিহাসবিদ কমল চৌধুরী বলছেন, কারখানার মিল চালানোর জন্যে ফারকুহার সাহেব ইছাপুর খালের জল ব্যবহার করেছিলেন, সে চেষ্টা যদিও ব্যর্থ হয়। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষদের থেকে অদ্ভুত গল্প শোনা যায়। সম্ভবত, অড়হরের বীজ শুকিয়ে বারুদের কোনো উপাদান তৈরি হত বলেই ইছাপুর খালের প্রশস্ত দুই পাড়ে, সারি সারি অড়হর গাছ লাগানো হয়েছিল সেইসময়। সেইসময়েই কাঁচড়াপাড়া এবং ব্যারাকপুরের মধ্যবর্তী যে ‘হাবেলিশহর পরগনা’ গড়ে উঠেছিল, তার দক্ষিণের সীমানা নির্দেশ করত ইছাপুর খাল।
কয়রাপুরের পর থেকেই ইছাপুর খালে পাঁকজল। উত্তর ব্যারাকপুর পৌরসভার সম্মিলিত বর্জ্য। জনবসতির চাপে সংকীর্ণ এবং ক্রমাগত সংকীর্ণতর হতে হতে ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি আর মেটাল অ্যান্ড স্টিল ফ্যাক্টরির মধ্যে দিয়ে সে বইছে। দু-পাশে একটা দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ। যখন ভীষণ বৃষ্টি পড়ে, খালের জল কৃষ্ণচূড়ার মতোই আগুন হয়ে ছোটে। রঙের তেমন পরিবর্তন হয় না। কালো, কালোই থেকে যায়।
সামান্য আলোর খোঁজ পাই, যখন জেনেছিলাম ইছাপুর খাল বা নোয়াই খাল বেয়ে চৈতন্যদেব সাঁইবনা থেকে কুলিয়া গিয়েছিলেন। অথচ ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, ইছাপুর খাল এবং নোয়াই খালের প্রায় এক সমকোণ দূরত্ব। বহু ইতিহাসবিদ এবং গবেষক নোয়াই এবং ইছাপুর—দুটি খালকেই একে অপরের কালো জলে গুলিয়ে দিয়েছেন। দুটি খাল স্বতন্ত্র, গতিপথ ভিন্ন এবং দারুণ প্রকট।
মন্ত্রেশ্বর মহানদী পার করে চৈতন্যদেব পিছলদা পর্যন্ত আসার পরে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃতে লিখছেন:
সেই নৌকায় চড়ি প্রভু আইলা পানিহাটি।
নাবিকেরে পরাইল নিজ কৃপা সাটি।।
প্রভু আইলা বলি লোকে হৈল কোলাহল।
মনুষ্যে ভরিল সব জল আর স্থল।।
রাঘব পণ্ডিত আসি প্রভু লঞা গেলা।
পথে যেতে লোকভিড় কষ্টেসৃষ্টে আইলা।।
একদিন প্রভু তথা করিয়া নিবাস।
প্রাতে কুমারহট্টে গেলা যাঁহা শ্রীনিবাস।।
তাঁহা হইতে আগে গেলা শিবানন্দ-ঘর।
বাসুদেব-গৃহে পাছে আইলা ঈশ্বর।।
বাচস্পতি-গৃহে প্রভু যেমতে রহিলা।
লোকভিড় ভয়ে যৈছে কুলিয়া আইলা।।
পানিহাটি— চৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ রাঘব পণ্ডিতের ভিটে, রাঘব ভবন।
চৈতন্যদেবের পানিহাটি থেকে কুলিয়া যাওয়ার যে নদীপথ, তা নিঃসন্দেহে হুগলি নদী। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত কিম্বা নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস গ্রন্থ থেকেও তেমনই আন্দাজ করা যায়, কিন্তু কোনো খালপথের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে কি তিনি নোয়াই খালে ভাসেননি কখনোই? এমনকি যে সাঁইবনা থেকে কুলিয়া যাওয়ার কথা বহুমুখে প্রচারিত, সেই সাঁইবনা প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে চৈতন্যদেব মারা যাওয়ার বহু বছর পরে!
হয়তো এ শুধুই গল্পকথা। অথবা একটি অতিমাত্রিক কল্পনা। যেখানে চৈতন্যদেবের নৌবহর, পানিহাটি থেকে নোয়াই খাল ধরে ইছাপুর খাল পেরিয়ে হুগলি নদীতে মিশে গিয়েছে। ভক্তি বড়ো দায়!
সাইকেল চালাচ্ছিলাম ইছাপুর খালের সঙ্গে সঙ্গে। উৎসমুখ অবধি পৌঁছতে পারলাম না। রাইফেল ফ্যাক্টরির গেটে আটকে গেলাম। ঘোষপাড়া রোডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি। কাছেই স্টোর বাজার। গমগম করছে সকাল-সন্ধে। কাঁচামাছ, পাকা আম আর খালের ঝাঁঝাল গন্ধ একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ। ‘মানুষের শিকড়বাকড় নিয়ে মানুষকে যেন খোঁজ রাখতেই হয়। পিছারার খালটিই যে আমার বা আমার মতো মানুষদের শিকড়ে বরাবর জল সিঞ্চন করে গেছে সে-কথা বুঝতে পারি যখন সেই স্রোতস্বিনীর স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাকে ধ্বস্ত করে চলে।…পিছারার খাল আমাকে যেন ক্রমশ এক বড় খালে নিয়ে ফেলে এবং বড় খাল, অনেক নাকের জল, চোখের জল করে একসময় এক অনিবার্য নদীর রহস্যময়তায় আমাকে পৌঁছে দেয়…’
ইছাপুর খাল আমাকে বড়ো খালে নিয়ে ফেলল কই?
ঋণ:
১. উত্তর চব্বিশ পরগণার সেকাল একাল, চতুর্থ খণ্ড, কানাইপদ রায়
২. ব্যারাকপুরের সেকাল একাল, দ্বিতীয় খণ্ড, কানাইপদ রায়
৩. চব্বিশ পরগণা, কমল চৌধুরী
৪. শ্রীশ্রীনবদ্বীপ-দর্পণ, শ্রীব্রজমোহন দাস
৫. প্রলয় ভট্টাচার্য
৬. সঞ্জিত মণ্ডল এবং অর্ধেন্দু বিশ্বাস
Powered by Froala Editor