মা গুপ্তমণি মন্দির: ৪৫০ বছর ধরে চলে আসছে শবরদের দুর্গাপুজো

কেউ বলেন ‘বন দুর্গা’, কারো কাছে তিনি ‘বন দেবী’। ভারতে পূজারিরা সাধারণত ব্রাহ্মণ। কিন্তু সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রাহ্মণেরা নন, এই মন্দিরের দুর্গা পুজো পান শবরদের হাতে। প্রাচীন এই উপজাতিরা উচ্চবর্ণের কাছে ‘নকলহেড’— অচ্ছুৎ— সমাজ বহিষ্কৃত— একঘরে। দেব বিগ্রহের কাছাকাছি ঘেঁষা অপরাধ। তবে, ঝাড়গ্রামের গুপ্তমণি মন্দিরের দুর্গার পুজো করেন এই শবররাই, নিজেদের মতো করে। ‘গুপ্তমণি’ (Guptamoni) শব্দটি একটি বিশেষ রাজবংশীয় এবং পৌরাণিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে।

প্রাচীনকালে ঝাড়গ্রাম (Jhargram) জঙ্গলঘেরা। সেখানেই রাজা নরসিংহ মল্লদেবের প্রাসাদ। তাঁর রাজ্য এবং মহার্ঘ রাজস্ব বাঁচাতে গোপন একটি পথ খুঁজে বের করেন এই অরণ্যে। গুপ্ত সেই পথেই শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতেন রাজা। কথিত আছে, শবরপতি নন্দভুক্তা জঙ্গলে গবাদি পশু চড়াতে এসে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। দেবী তাঁর স্বপ্নে আসেন। বলেন, পুজো করতে। নন্দভুক্তা তাঁর পরিবারকে এই আশ্চর্য স্বপ্নের কথা জানান। ঘটনাটি সেখান থেকেই নতুন মোড় নেয়। রাজা নরসিংহের আদরের এক হাতির নাম ‘গজ'। পাগল হয়ে নিখোঁজ রাজ-ঐরাবত। বহু তল্লাশির পরেও হদিশ মেলে না। এদিকে, রাজাকেও স্বপ্ন দেন দেবী। বলেন, নন্দভুক্তার কাছে যেতে। নন্দভুক্তাই জানেন, তাঁর প্রিয় গজের হদিশ। দেবীর কথামতো রাজা দলবল নিয়ে নন্দভুক্তার কাছে যান। রাজামশাইকে স্বপ্নদৃষ্ট স্থানে নিয়ে যান শবরপতি । সেখানেই নন্দভুক্তার দেবীর বীজমন্ত্র পাঠ। রাজামশাই ফিরে পান প্রিয় হাতি। পরের দিনই মন্ত্রীকে ডেকে নিদান, ওই জায়গায় তৈরি হবে মন্দির। দেবী যেহেতু গুপ্তভাবে, তাই মন্দিরের নামও ‘গুপ্তমণি’। সেই থেকে লোধা শবররা নিজেদের মতো করে দেবী গুপ্তমণির পুজো করে আসছেন। সুখনিবাসের এই জঙ্গলও শবরদের দিয়ে দেন মল্লদেব। অর্থাৎ এভাবেই মল্লদেব ভেঙে দিলেন বর্ণবাদ প্রথার রক্তাক্ত দেওয়াল।

সাড়ে চারশো বছরের এই মন্দিরের বর্তমান ভবনটি প্রাথমিক নির্মাণ নয়। এখনকার কাঠামোর বাঁ-দিকে আরেকটি নির্জন মন্দির। জনশ্রুতি, মন্দিরটি বজ্রপাতের ফলে দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মন্দিরটিতে ওডিসি শৈলীর ছাপ। শীর্ষে সুদর্শন চক্র, যা বর্তমান অবস্থায় খণ্ডিত। ১৯৩৭ সালে নতুনভাবে নির্মিত হয় মন্দিরটি। আগে এখানে সোনার মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। যদিও ১৯০৩ থেকে ১৯০৭ সালের মধ্যে এই সোনার মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়, নবরূপে মন্দিরটি নির্মাণের প্রায় তিন দশক আগে। পরবর্তীতে পরশ পাথরের একটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল।

ভক্ত ও পর্যটকদের স্বাগত জানাতে মন্দিরের প্রবেশপথের পাশে একটি বিশাল টাওয়ার। গেটের সামনের দিকে টিকিট কাউন্টার। এর পাশেই পার্কিং লট। টিকিট কাউন্টারের উলটো দিকে বনের সব পাখির ছবি সংবলিত ব্যানার। এই ব্যানারের কাছেই একটি লজ। সেখান থেকে কয়েক কদম এগোলে বাঁ-দিকে ডুলুং নদী মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। নদীতে বোটিং করলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মজে থাকা যায়। যদিও নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেট পরা বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন
ঔষধি গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দির

বর্তমান মন্দিরের বাঁ-দিকে একটি প্রাচীন গাছ। ভক্তরা ইচ্ছাপূরণের জন্য লাল-হলুদ রঙের সুতো বেঁধে রাখেন মাটির হাতি ঘোড়া। ঘন জঙ্গল মনোযোগী প্রহরীর মতো মন্দিরকে ঘিরে রেখেছে। দেবী দুর্গা এখানে পাথরের। কথিত আছে, যে পথে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতেন, রাজা নরসিংহ জঙ্গলের ওই গোপন পথ রক্ষার দায়িত্ব দেন শবরদের। শবররাই আগলে রাখেন অরণ্যের একচিলতে রাস্তা। এভাবেই রক্ষা পায় রাজবাড়ি। তখন থেকেই পাথুরে গুপ্তমণির পুজো। পাথরের উপর ঘট বসিয়ে হয় পুজোপাঠ। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে দুর্গার ছবি ছাড়া কোনও দেবীর মূর্তি নেই। বাইরের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি। আঁকা রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। দুর্গাপুজোর সময় রাজমহল থেকে আসে শাড়ি, পলা, ফুল।

আরও পড়ুন
নজরুলের গানে অনাগত স্বাধীনতার চেতনা এবং ‘দেবী দুর্গা’ নাটক

মন্দিরের কাছাকাছি কিছু দোকান আছে। চাইলে পুজো উপাচার কেনা যায়। দুপুর ১টার মধ্যে দেবী দুর্গাকে ‘ভোগ’ উৎসর্গ করা হয়। দৈনিক মাছ এবং পায়েস থাকে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। ‘ভোগে’র জন্য প্রতিদিন রান্না হয় ভাত। রান্না শুরু সকাল ১০টায়। সকাল ১০টার আগে মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ‘ভোগ’ সংগ্রহের কুপন সংগ্রহ করতে পারেন। রয়েছে পার্সেল সুবিধাও। কিছু সামাজিক আচার যেমন বিবাহ, অন্নপ্রাশন গুপ্তমণি মন্দিরে অনেকেই আয়োজন করেন। তবে, শাস্ত্রসম্মত বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট জমা দেওয়া অবশ্যকরণীয়।

প্রতিদিন দেবীকে নারকেল, কলা, আপেল এবং দুধ নিবেদন করা হয়। দুর্গাপুজো, মকর সংক্রান্তি এবং অম্বুবাচীর সময় বিশেষভাবে আয়োজিত হয় পূজার্চনা। অষ্টমীতে ফল বলি এবং সপ্তমী ও নবমীতে একটি ভেড়া বলি দেওয়া হয়। দশমীর দিন এই স্থানে বহু ভক্তের সমাগম হয়। মন্দিরটি ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের (বোম্বে রোড) পাশে। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে রাজবাঁধের মা গুপ্তমমণি মন্দিরে পৌঁছতে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে যেতে হবে। খড়গপুর থেকে দূরত্ব ২২ কিমি।

Powered by Froala Editor