ঔষধি গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দির

কুচিলা ফল বা গাছ চেনেন? যে গাছ থেকে মেলে স্ট্রিকনিন। স্ট্রিকনিন একটি ক্ষার, যা ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভাবিত হয়েছিল। নাক্স-ভোমিকার বীজ থেকে এর জন্ম। স্বাদে খুব তেঁতো এই ফল ওষুধে ব্যবহৃত হয়। এই ফলের বাংলা নাম কুচিলা। একে কুচালা, জহরা, কাজরা ইত্যাদিও বলা হয়। বোটানিক্যাল নামের স্ট্রিচনোস নাক্স ভোমিকা ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় গাছ। যা রয়েছে ডুলুং নদী সংলগ্ন গভীর জঙ্গলে। কোথায় এই ডুলুং নদী? চিল্কিগড় ঝাড়গ্রামে। শাল পলাশের কুঁজকানন শোভা বাড়াচ্ছে অরণ্যের। এর পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ডুলুং। ডুলুংয়ের এপারে রয়েছে বনভূমি-ঘেরা কনক দুর্গা মন্দির।

প্রায় ৭০ একর বনভূমি সম্পূর্ণ ঔষধি গাছ দিয়ে ঘেরা। গোটা ভারত থেকে বোটানিস্টরা ওষুধ নিয়ে গবেষণা করতে এই জঙ্গলে হাজির হন। জনশ্রুতি, কনক-দুর্গা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা গোপীনাথ সিংহ রায়ের উত্তরসূরীরা নাকি আয়ুর্বেদিক চর্চায় পারদর্শী ছিলেন। তাই তাঁরাই বিভিন্ন ঔষধি গাছ সংগ্রহ করে বানিয়েছিলেন ঔষধি বনাঞ্চল। জানা যায়, ৪৩৩ ধরনের ঔষধি গাছ এই বনাঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে। মন্দিরের পশ্চিম দিকে এই ঔষধি জঙ্গল। আর পূর্বে খরস্রোতা ডুলুং। ডুলুং নদী থেকে ঘট ভর্তি হয়ে জল আসে ষষ্ঠীতে। মন্দিরের বাইরে আছে একটা বেলগাছ। গোটা রাত্রি বেলগাছের নীচে রাখা হয় ঘট। সপ্তমীর সকালে ঘট করা হয় শুদ্ধ। এরজন্য লাগে কলসির জল। এরপর হোম আরতির গৃহপ্রবেশ।

জামবনি পোস্ট অফিসকে বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের থেকে গেটওয়ে অফ বেঙ্গল বলা যেতেই পারে। এখানে ডুলুং নদী আদিবাসী গ্রামগুলির মধ্য দিয়ে নীরবতার কবিতা আঁকে। স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যে সেখানে নৌযান চলাচল, বাচ্চাদের জন্য খেলার পার্ক এবং মূল মন্দির সংলগ্ন অতিথি নিবাস গড়ে উঠেছে। পরিবেশ পর্যটনে বিকাশের জন্য এসব পদক্ষেপ। কাছাকাছি এলাকার মধ্যেই আপনার বুদ্ধিতে শান দেওয়ার জন্য চায়ের দোকানও রয়েছে। পরিবেশ প্রেমীদের জন্য তীর্থক্ষেত্র এই জায়গা। তবে হ্যাঁ, বানর হইতে সাবধান। আচমকাই তারা এসে আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

চিল্কিগড়ের ইতিহাস ধলভূমের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ধলভূমের প্রথম রাজা সূর্যবংশ রাজা রামচন্দ্র। তাঁর পুত্র বীর সিংহ। বীরসিংহের ছিল দুই পুত্র— গুণধর সিংহ এবং জগৎদেও সিংহ। এক সময় গুণধর ও জগৎদেওর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। জগৎদেও তাঁর বাসা ছেড়ে তারপর বিহার চলে যান। তিনি বিহারের একটি অংশে এসেছিলেন, এখন ঝাড়খণ্ড, যা ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছিল। জায়গাটি তাঁর বেশ পছন্দ হয়। সেসময় জগৎদেও এবং ধবলদেব সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়েন। জগৎদেও খুব সহজেই ধবলদেবকে পরাজিত করেন। ধবলদেবের রানির অনুরোধে জগৎদেও তাঁর স্মরণে 'ধবলদেব' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় পুরীর জগন্নাথদেবের গৌরব কথা ব্যাপক জনপ্রিয়। ধবলদেব তাঁর নাম পরিবর্তন করে জগন্নাথদেব ধবলদেব রেখেছিলেন। তিনি জগন্নাথ নামের আট রাজার সপ্তম ছিলেন। জগৎদেও জঙ্গলমহলে রাজা গোপীনাথের সংস্পর্শে আসেন। রাজা গোপীনাথ তাঁর একমাত্র কন্যা সুবর্ণ মণির সঙ্গে জগৎদেওর বিয়ে দেন। এই বিয়ের পরে জঙ্গলমহল ও ধলভূমের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়। পরে মন গোবিন্দ চিল্কিগড়ের রাজা হন। তিনি তিরিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। মন গোবিন্দ ছিলেন ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। শেষ রাজা ছিলেন ১৯৫৩ সালে অবধি রাজা জগদীশচন্দ্র।

আরও পড়ুন
কুমোরটুলির ভিড়, দুর্গা-অসুরের রূপ আর কিছু বিবর্তনের গল্প

চিল্কিগড়ের একটি ভিন্নধর্মী জনসংখ্যা রয়েছে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসবাস করছেন। তাদের সকলেই সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে তাকে সংস্কৃতির একটি গলিত পাত্রে পরিণত করেছেন। এখানে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণেরা পাশাপাশি বাস করছেন বাগদি, বাউরিস সাঁওতালদের মতো উপজাতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে।

আরও পড়ুন
বিপ্লবীর স্মৃতিজড়িত দুর্গাপুজো, আড়বালিয়া ও একশো বছরের কিস্‌সা

এবার ফিরি মূল গল্পে। যা একটি স্বপ্নকে ঘিরে। দেবী মহামায়া স্বপ্নে এসেছিলেন। রাজা গোপীনাথকে তাঁর উপাসনার জন্য একটি মন্দির বানানোর আদেশ করেছিলেন। কথিত আছে, সেই স্বপ্নে স্বয়ং দেবী মহামায়া তাঁর বিগ্রহের রূপ বর্ণনা করেছিলেন। পরের দিন সকালে গোপীনাথ দু'জন দর্শনার্থীকে খুঁজে পেলেন, যাঁরা রাতে একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা ছিলেন শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ কামিল্য এবং রামচন্দ্র সরঙ্গী। যোগেন্দ্রনাথ এই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, দেবী কনক দুর্গা হলেন দেবী চণ্ডী। তিনি শক্তির দেবী। পুরাতন মন্দিরগুলি বড়মহল নামে বহুল পরিচিত। পরে রাজা কমলাকান্ত মন্দির স্থানান্তর করবার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে তিনি স্বপ্নে নীল শাড়ি পরিহিত দেবী কনক দুর্গাকে দেখেন। দেবী রাজাকে তাঁর মন্দির স্থানান্তর না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যার ফলে দেবী কনক দুর্গা এখন তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই একই জায়গায় রয়েছেন। বলা হয়, রাজার পরিবার নীল শাড়ি পরে। আর কেবলমাত্র সরঙ্গী (ব্রাহ্মণ) উপাধিধারী ব্যক্তিই মন্দিরের পূজারি হতে পারেন।

লোকমুখে ঘুরে ফেরে আরো একটি কথা। এক সময় সেই অঞ্চলের মানুষ নাকি অনাহারে ছিল। একদিন তারা একটি অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। একদিন বজ্রবিদ্যুৎ-সহ প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। যদিও বৃষ্টি কোনও প্রাণ কেড়ে নেয়নি। চিল্কিগড়ের এক প্রৌঢ় এই ঘটনাকে দেবী মহামায়ার অনুগ্রহ বলে চিহ্নিত করলেন। সেখানকার বাসিন্দারা একটি বটবৃক্ষের নিচে ছোট এক মন্দির স্থাপন করে দেবী মহামায়ার কাছে বিনীতভাবে সমর্পণ করেছিলেন। প্রায় চার শতক পুরনো বৃদ্ধ-ঋদ্ধ গাছটি এখনো সাক্ষী হিসেবে শান্ত মর্যাদায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সময় কেটে গেছে। কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মন্দিরের সামনের দিকে একটি বিশাল পাথর। বাসিন্দারা মনে করেন, এই পাথরটি একটি চাবিকাঠি, যা একটি অভ্যন্তরীণ কক্ষের দিকে নিয়ে যায়। সেই কক্ষটি একটি সীমাবদ্ধ জায়গা। অন্তর্নিহিত গোপন কক্ষে কেবলমাত্র একজন সরঙ্গী ব্রাহ্মণ ছাড়া সকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিভিন্ন ধরনের গাছ এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ঘিরে রয়েছে মন্দিরটিকে। সেই বনে রয়েছে শিবের মনোরম ছোট ছোট মন্দির।

এখানেই শেষ নয়। অরণ্যের আনাচ-কানাচে কান পাতলে শোনা যায় আরও কিছু গল্প। তেমনই এই অঞ্চলের রক্ষক হিসাবে দেবী মহামায়ার আর একটি মৌখিক গল্প বহু প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে। প্রথমদিকে মন্দিরের পুরোহিত অন্ধকার রাতে অরণ্যের মধ্য দিয়ে একা ঘরে ফিরে আসতে ভয় পেয়েছিলেন। কথিত রয়েছে যে, দেবী মহামায়া সেই পুরোহিতকে সুরক্ষার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে শর্ত ছিল, পিছন ফিরে তাকানো যাবে না। এভাবেই মহামায়ার সুরক্ষার অধীনে পুরোহিত রাতের পর রাত নির্ভীক বনের মধ্য দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে কনক দুর্গার মহিমা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

এবার আসি প্রতিমার কথায়। রাজা গোপীনাথের সময় দেবী কনক দুর্গার প্রথম মূর্তি পাথরের তৈরি ছিল। পরে এর স্বর্ণমূর্তি হয়। 'কনক' শব্দের অর্থ হল 'সোনা'। থিডলের আইকনোগ্রাফি থেকে আমরা তৎকালীন সমাজের একটি স্বতন্ত্র চিত্র পাই। মন্দিরটিতে ওড়িশার মন্দিরের স্থাপত্য এবং লোক ঐতিহ্যের প্রভাব রয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র মন্দিরে খোদাই করা আছে। আজকের দিনে প্রধান মন্দিরটির জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে আমরা সেসব আর পড়তে পারি না। মন্দিরটি স্মরণ করিয়ে দেয় কোনারকের সূর্য মন্দিরকে। মন্দিরের স্থাপত্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, সহজেই তাঁরা বলে দেবেন যে, কনক দুর্গা মন্দির আজ থেকে প্রায় তিন-চারশো বছর আগের। মন্দিরের সামনের দিকে রয়েছে বিশাল এক বটবৃক্ষ। এই গাছটির বয়স প্রায় তিনশো বছর। হিন্দু বিশ্বজগতের একটি পবিত্র গাছ হিসাবে বিবেচিত এই বট। বানররা, যারা আশপাশের বনাঞ্চলে বাস করে, তাদের কেউ ক্ষতি করে না। এই বানরগুলি এই রহস্যময় এবং সুন্দর জায়গার ইকোসিস্টেমের মূল্যবান অংশ। তারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।

বছরের পর বছর ধরে চিল্কিগড় বিবিধ সাংস্কৃতিক গুরুত্বের একটি জায়গা হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই মন্দিরটি ছিল আর্য ও অনার্যদের সংস্কৃতির মিলনের স্থান। মন্দিরটি ধর্মীয় আচার এবং সমাজ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি হিসেবে রয়ে গিয়েছে। এখানকার কনক দুর্গা এবং তাঁর মন্দিরটি জীবিত ইতিহাস হিসেবে দাঁড়িয়েছে। রাজা মন গোবিন্দের সময় 'ঘুড়ি উৎসব' নামে এক উৎসব চালু ছিল এখানে। এটি একটি পবিত্র উৎসব হিসেবে বিবেচিত, যা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক মূল্যবান অংশ। শিল্পী জগন্নাথ দাস রাজার পক্ষে বানাতেন এক বিশাল ঘুড়ি। দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে জায়গাটি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আর্য সংস্কৃতি উৎসবের দিনগুলিতে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

দুব্রা, পরিহাতী, গিদনী, জাম্বোনি, আলমপুর প্রভৃতি পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্থানীয় মানুষের উপর এই মন্দিরের প্রভাব আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তাঁদের দাবি, মন্দিরটি এই অঞ্চলের প্রাচীনতম। তাঁদের কাছে মন্দিরটি মানসিক শান্তির আবাস। তাঁদের সেই শান্তির আবাস এই মন্দির সংলগ্ন ঘন অরণ্যে অষ্টমীতে হয় নিশিপুজো। এই পুজোয় উপস্থিত থাকতে পারেন কেবল রাজপরিবারের সদস্যরা। নবমীতে হয় ভোগ রন্ধন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই ভোগ নাকি রাঁধেন স্বয়ং দেবী। এরপর দশমীতে হয় কলাগাছরূপী রাবণ পুজো। সন্ধ্যাবেলা ডুলুং নদীর তীরে জড়ো হয় সকলে। এরপর চলে কলাগাছের রাবণকে তির মারার প্রতিযোগিতা। ২০০৭-০৮ সালে দুবার চুরি গিয়েছিল মূর্তি। এরপর মন্দিরে বসে সিসিটিভি ক্যামেরা। নতুন করে তৈরি হয় মূর্তি। দেবীর করা হয় অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি। নতুন করে তৈরি হওয়া চেকপোস্টে বসে থাকেন রক্ষী। গাছেদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও নিযুক্ত করা হয়েছে কিছু মানুষকে। ইতিহাসকে বাঁচিয়ে এভাবেই রাখা যায়।

Powered by Froala Editor