কল্পবিজ্ঞানের ‘শেক্সপিয়র’ তিনি, ১০০ বছর আগেই দেখিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ

আচ্ছা, আপনি কি নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন? আজ থেকে একশো বছর পর পৃথিবীর অবস্থা কী হবে, মানুষের অবস্থা কী হবে, বলতে পারেন? বা বিজ্ঞান আর কী কী আশ্চর্য নিয়ে হাজির হবে, সেসব? টাইম মেশিনের কথা আমরা কল্পনা করি বটে, অনেক সিনেমাতেও ঘুরে ফিরে এসেছে সেসব; কিন্তু বাস্তবে তো এখনও আসেনি। তাহলে কি জ্যোতিষের গণনার কথা হচ্ছে? না, জ্যোতিষ নয়। তবে বিংশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে একজন মানুষ এমন সব জিনিস লিখে গিয়েছিলেন, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যি হয়ে সামনে এসেছে। কোনো অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার নয়; লেখক এইচ জি ওয়েলস ছিলেন এমনই বিরল মানুষ।

তাঁকে বলা হয় ‘শেক্সপিয়র অফ সায়েন্স ফিকশন’। কল্পবিজ্ঞানকে অসম্ভব রূপ দিয়ে নিজের লেখায় হাজির করতেন এইচ জি ওয়েলস। টানটান উত্তেজনার সঙ্গে থাকত অনুসন্ধিৎসু মন। নিজে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পাশাপাশি বেড়ে উঠছিল সাহিত্যের নেশা। একটা সময় এই দুটো এক হয়ে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত হল। কল্পনার রথে চড়ে উড়ে বেড়াতে লাগলেন নানা জায়গায়; অবশ্যই ঘোড়াটি ছিল বিজ্ঞান। চার চারবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও পেয়েছিলেন; কিন্তু আফসোস, পাননি। তাই বলে সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর কৃতিত্ব এতটুকুও কমে না। সায়েন্স ফিকশন জঁরকে তিনি নতুনভাবে হাজির করেছিলেন আমাদের সামনে। সেই কাজটি করতে গিয়েই ঘটিয়ে ফেললেন অঘটন।

সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কল্পনা, যার ভিত্তি হল বিজ্ঞান। যা আমাদের প্রতিনিয়ত কৌতূহল বাড়ায়, আরও ভাবতে, ভাবাতে বাধ্য করে। কখন যে সেই ভাবনার কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলো উঠে আসবে, তার ঠিক নেই। বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি কল্পবিজ্ঞানের লেখকরাও এমন অনেক কিছুর কল্পনা করে গেছেন যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সত্যি হয়ে উঠেছে। এইচ জি ওয়েলস সেই পথেরই সারথি। ‘দ্য টাইম মেশিন’-এর লেখক এমন ছয়টি জিনিসের কল্পনা করেছিলেন এবং তার বর্ণনা লিখে গিয়েছিলেন, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রখর বাস্তব। বিংশ শতকের শুরুতে দাঁড়িয়ে যা ছিল অসম্ভব।

বলতে বলতে মাথায় আসবে ‘মেন লাইক গডস’ বইটির কথা। আজ এই প্রতিবেদনটি লেখাও যেত না, এবং আপনারা পড়তেও পারতেন না, যদি ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির অস্তিত্ব থাকত। অনেকেই মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে পড়ে নেবেন লেখাটি। এই ফোন বা মোবাইল, টেলিভিশনের ধারণাটাই নিজের লেখায় তুলে ধরেছিলেন এইচ জি ওয়েলস। তিনি ভেবেছিলেন, একদিন এমন আসবে যেদিন দূরত্বে থেকেও মানুষরা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের আকরটা তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভেবেছিলেন চিঠি চালাচালিও এই ওয়্যারলেস পদ্ধতিতেই হবে। আজ যাকে ‘ইমেল’ বলে জানি আমরা…

আরও পড়ুন
৬ বছরের বন্দিদশা শেষ, মুক্তির পথে কুর্দিশ-ইরানিয়ান লেখক বেহরুজ বুখানি

ছাত্র বয়সে জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন ওয়েলস। নিজের লেখাতেও নানা সময় ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই প্রসঙ্গ। মনে পড়বে ১৮৯৬ সালে লেখা ‘দ্য আইল্যান্ড অফ ডঃ মোরেউ’ গল্পে তিনি এনেছিলেন লেপার্ড-ম্যান, ফক্স-বিয়ার উইচকে। দুটো ভিন্ন প্রজাতির জিনকে মিশিয়ে নতুন প্রাণী তৈরি— অনেকটা মারভেল বা ডিসি’র কমিকসের চরিত্রের মতো লাগছে না? জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাথমিক ধারণাটুকু এভাবেই তুলে ধরেছিলেন নিজের লেখায়। আজ তার উদাহরণ দেখতে পাই নানা জায়গায়। কখনও বাঘ আর সিংহের জিনকে মিশিয়ে তৈরি হয় লাইগার। আবার মশা দমনের জন্য জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রয়োগ ঘটানো হয়।

১৯৪৫ সাল। আগস্ট মাসের দুটো অভিশপ্ত দিন জাপানের ওপর নেমে এল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ভয়াবহতা দেখল বিশ্ব। লিটল বয় আর ফ্যাট ম্যানের দাপটে হিরোশিমা আর নাগাসাকি শ্মশান হয়ে গেল চোখের পলকে। হ্যাঁ, পারমাণবিক বোমা। যে জিনিস বিশ্বের কল্যাণের কাজে ব্যবহার করা যেত, তা বদলে গেল আতঙ্কে। কাট টু ১৯১৩ সাল। ৩২ বছর আগে এইচ জি ওয়েলস বলে গিয়েছিলেন এমন একটি দিনের কথা। পরমাণুকে ভেঙে যে বিপুল শক্তি উৎপন্ন হবে, তা দিয়ে তৈরি হবে মারণাস্ত্র। সেইসঙ্গে ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’-এ তিনি বলেছিলেন ‘হিট-রে’ নামক একটি যন্ত্রের কথা। এমন একটি অস্ত্র, যা আলোর একটা ফ্ল্যাশে পৌঁছে যাবে লক্ষ্যে। এর ছয় দশক পর ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণাগারে থিয়োডোর মেইম্যান প্রথম লেজার তৈরি করেন। পরে তার সাহায্যেই তৈরি হয় আধুনিক অস্ত্র, মিশাইল। ঠিক যেন হিট-রে!

আরও পড়ুন
আমার লেখক হওয়ার ইচ্ছে শুনেই হেসেছিলেন মা : রাস্কিন বন্ড

১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশযানটি পৌঁছে গিয়েছিল চাঁদে। নানা রটনা, মিথ তৈরি হয়েছে এই ইতিহাস ঘিরে। এমন একটি দিন যে আসতে পারে, সেটাও কল্পনা করে গিয়েছিলেন এইচ জি ওয়েলস। ‘দ্য ফার্স্ট মেন ইন দ্য মুন’ গল্পে দেখিয়েছিলেন চন্দ্রাভিযানের কথা। এইভাবেই নানা সময় বিজ্ঞানকে সত্যি করে তুলেছিলেন এইচ জি ওয়েলস। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা তো একেই বলে! 

তথ্যসূত্র-
১) '6 future predictions by HG Wells, the father of Sci-fi, that came true', Tanya Saihgal, India Today
২) 'The many futuristic predictions of H.G. Wells that came true', Brian Handwerk, Smithsonian Magazine

আরও পড়ুন
৪,৩০০ বছর আগেকার মন্ত্র খোদাই পাথরে, বিশ্বের প্রাচীনতম লেখক এক নারী

Powered by Froala Editor

More From Author See More