নববর্ষের খাতায় পদ্য লিখলেন শক্তিদা, মৃত্যুর ছায়া ফুটে উঠল শ্যামলদার কলমে

ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি, দু-তিন রূপে আমাদের সামনে এসে হাজির হয় পয়লা বৈশাখ। তখন রেডিও-র বেশ চল ছিল। সেখানে সকাল হলেই ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ দিয়ে নববর্ষকে আহ্বান করা হত। এছাড়াও ছিল চৈত্র সেল। চারিদিকে ‘সেল সেল সেল’; দোকানগুলোয় ভিড় শুরু হত। সে এক এলাহি ব্যাপার। তারপর, ছাদে উঠে ‘শত্রু বলি’ দিতাম। ইটের ওপর একটা আম রেখে, সেটাকে দাঁ দিয়ে কচাৎ করে কেটে দেওয়া হত। ভারী আনন্দের ছিল সেসব। এতে নাকি শত্রু নাশ হত। কে জানে, হয়েছে কিনা!

তবে আরও একটি ঘটনার সঙ্গে আমার পয়লা বৈশাখ জড়িয়ে আছে। একটা সময় মফঃস্বলে থাকতাম। তখন, শিবঠাকুরকে আসতে দেখতাম আমরা। ছিটের বাঘের ছাল পরে, গায়ে ছাই মেখে ‘তিনি’ আসতেন। সঙ্গে রাংতার মুকুট পরা পার্বতী। ওঁরা এসে, পাড়ার দোকান থেকে ভাঁড়ের চা আর শক্ত কড়কড়ে বিস্কুট ভাঁড়ে ভিজিয়ে খেতেন। তারপর মহাদেব বিড়ি-টিড়ি টেনে বাড়ি বাড়ি আসতেন। আমরা সবাই আলু, চাল, কিছু নগদ টাকা দিতাম। ওঁরাও বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেসব নিতেন। আশীর্বাদও করতেন বোধহয়! জিজ্ঞেস করা হয়নি সেটা আর…

কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে পরিচয় ছাত্র বয়স থেকেই। আমি হেয়ার স্কুলে পড়তাম। তো এই সময় বইপাড়ার বইয়ের দোকানগুলো দেখতাম। আর দেখতাম পুঁটিরাম, প্যারামাউন্ট, বসন্ত কেবিনকে। তখন লেখালেখি শুরু লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে। কিন্তু ওরা তো এত জাঁকজমকভাবে নববর্ষ পালন করে না। বইপাড়ার প্রকাশনী সংস্থাগুলির নববর্ষের সঙ্গে আমার নিয়মিত পরিচয় মোটামুটি নব্বইয়ের দশক, উপন্যাস লেখার পর থেকে। উপন্যাস না লিখলে তো গল্পকারদের ওই আড্ডায় তেমন জায়গা হত না। তবে, তার আগেও দেখেছি সমরেশ বসু-কে। এছাড়াও সমরেশ মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ এঁরা তো আসতেনই। দে’জ পাবলিশিংয়ে তখন রীতিমতো আড্ডা বসত এই দিনে। সবাই আসতেন, ছোটো থেকে বড়ো প্রায় অনেকেই। দেখেছি ভেতরে বসে আছেন প্রফুল্ল রায়, নিমাই ভট্টাচার্য প্রমুখরা। আমিও গুটি গুটি করে এসে বসতাম।

দে’জ-এ বেশ কিছু সুন্দর প্রথা ছিল। তাঁর একটি হল খাতা। ওইদিন সামনে একটি খাতা রাখা থাকত; আর তাতে নামী লেখক, সাহিত্যিক, কবিরা এসে সামান্য কিছু লিখে দিয়ে যেতেন। কেউ লিখতেন ‘শুভ নববর্ষ’, আবার কেউ লিখতেন ‘দে’জের কোনো তুলনা নেই’ এইসব আর কী। তবে অনেকে বানিয়ে বানিয়ে তিন চার লাইন লিখেও আসতেন। এই প্রসঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। শক্তিদা ওই খাতায় পদ্য লিখেছিলেন, “সারাজীবন ধরে কে ছাপবে কে ছাপবে বলে এই চিৎকার/ ভালোবাসা না মন্দবাসা, কে জানে যে কে শক্তি?” কখনও শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় এসে কোনো লাইন লিখে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে, ওই খাতাটি বেশ অভিনব ব্যাপার ছিল। আমি অবশ্য ওই খাতায় পৌঁছেছি দু-চার বছর পর। একটু বুড়ো বুড়ো হয়েছি যখন, তখন…

এইখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা ভালো। এই খাতায় লেখার ব্যাপারটি সম্ভবত শুরু করেছিল মিত্র এবং ঘোষ প্রকাশনী। ভানুবাবু’র কাছ থেকে এমনটা শুনেছিলাম। ওখানেও এমন একটি খাতা আছে। শুনেছি, একটা সময় দুই বিভূতিভূষণ, শিবরাম চক্রবর্তী, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত’রা আসতেন এখানে। একটা ঘটনা হঠাৎ মনে এল আমার। জানি না, কীভাবে ব্যাখ্যা দেব। এটা অবশ্য দে’জের ঘটনা। সেবার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছেন। যথারীতি খাতা এগিয়ে এল তাঁর কাছে। সেখানে লিখলেন, “সামনের বছর কি আর আসতে পারব?” তার পরের বছর, সত্যিই তিনি আর এলেন না। সবাইকে ছেড়ে সেই যে চলে গেলেন…

দে’জ-এর আরেকটা ব্যাপার ছিল, ডাব খাওয়ানো। ডাবের জলের চল অন্যান্য জায়গাতেও ছিল; এমনকি আনন্দ পাবলিশার্সেও। কিন্তু ওখানে কাচের গ্লাসে করে ডাবের জল দেওয়া হত। দে’জে ব্যাপারটা একটু অন্য ছিল। গ্লাস-টাস কিচ্ছু না, আস্ত ডাবের মাথাটা কেটে একটা স্ট্র দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত। দিব্যি লাগত পুরো ব্যাপারটা! এই ডাব কাটাও একটা অদ্ভুত আর্ট। সবাই কিন্তু পারে না কাটতে! দক্ষ শিল্পী ছাড়া এই জিনিস হয় না। বোধহয় এই ‘শিল্পী’র অভাবেই ডাব দেওয়ার প্রথাটা আর হয় না।

আনন্দ-তে আড্ডাটা একটু ফর্মাল ছিল। সবাই আসতেন, সব চুপচাপ বসে থাকতেন। খবরাখবর নিচ্ছেন একে অন্যের। সামনে বসে থাকতেন সম্পাদক অরূপ সরকার। ওঁর সামনে জোরে কথা বলার লোক খুব কম ছিল। সমরেশ বসু’র মতো মানুষরাই সেই সাহস নিতে পারতেন। সেখানে দেখতাম সমসময়ের লেখক, কবিদের। আমাদের চেয়ে ছোটোরাও থাকত। তিলোত্তমা মজুমদার ছিলেন। ডাবের জল তো ছিলই, সঙ্গে ছিল নকুড়ের মিষ্টি। কখনও কখনও বলরাম মল্লিকের দোকান থেকেও আসত। খাওয়ানোও হত এসব জায়গায়। কখনও পাত পেড়ে, কখনও আবার পার্সেল করা হত।

আস্তে আস্তে সময় এগিয়েছে। অনেক রীতির বদল হয়েছে, অনেক কিছু আবার একরকম আছে। আগে বাড়ি বাড়ি চপ, শিঙাড়া ভেজে নিয়ে আসা হত। এখন এর চলও কিছুটা কমেছে। কত কিছুই তো হারিয়ে যাচ্ছে এভাবে। ছোটবেলায় যে শিব-পার্বতীকে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াতে দেখতাম, ওদেরও এখন দেখতে পাই না। বড়ো প্রকাশনীর পাশাপাশি ছোটো ছোটো কিছু পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থাগুলোও নিজেদের মতো করে বর্ষবরণ করছে।

তবে একটা জায়গায় বড়ো আশ্চর্য লাগে। বাঙালিদের বাংলা দিনের হিসেব বলতে তো পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ; আর য়লা বৈশাখ। এই দিনগুলোতেই বাংলা ক্যালেন্ডার জ্যান্ত হয়ে ওঠে। বাকি তো সবই ইংরেজিতে হিসাব হয়। সরস্বতী পুজোই হোক বা দুর্গাপুজো— সবেতেই একই ছবি। থেকে-থেকেই ভাবিয়ে তোলে এই কথাও...

(অনুলিখন – অরিত্র সোম)

Powered by Froala Editor