যতীন দাস থেকে স্ট্যান স্বামী, রাজনৈতিক বন্দিদের অবস্থা বিশেষ বদলেছে কি?

যতীন দাস (Jatin Das) ভারতের প্রথম ব্যক্তি যিনি রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য লড়াই করতে গিয়ে শহিদ হন। তাঁর ঐতিহাসিক অনশন ব্রিটিশ রাজের অধীনে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর নৃশংসতাকে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিল। তাঁর এই কর্মযজ্ঞ আজও প্রাসঙ্গিক।

অসহযোগ আন্দোলনের সময় কলেজ পড়ুয়া যতীন দাসের রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ। এই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য কলেজ ছাড়তে দ্বিধা করেননি। যদিও এতে তাঁর বাবা বঙ্কিমবিহারী দাস ক্ষুব্ধ হন। যারপরনাই তাঁর পুত্রকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। যতীন বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন অতি দারিদ্র্যের মধ্যে কাটিয়েছেন। এরপর তাঁর ভবানীপুর কংগ্রেস কমিটির অফিসে যাওয়া। কংগ্রেস নেতারা তাঁকে দলের আর্থিক তহবিল থেকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ সেই অর্থ তো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অনুদান। অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর যতীন দাস পুনরায় কলেজে যোগদান করেন। তাঁর স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেন।

অসহযোগ আন্দোলনের সময়ই যতীন দাস উত্তর ভারতের বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা শচীন্দ্রনাথ সান্যালের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর মাধ্যমেই যতীন দাসের বিপ্লবী দল হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি-র সদস্য হওয়া। আন্দামান জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শচীন্দ্রনাথের ১৯২৩ সালে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা। যতীন দাসও এই অ্যাসোসিয়েশনের কাজে নিজেকে নিযুক্ত করে শচীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। এরপরই সংগঠনটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার সামলানোর যাত্রা শুরু যতীন দাসের।

৩১ জানুয়ারি, ১৯২৫। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের ইশতেহার 'বিপ্লবী' উত্তর ভারতের প্রধান শহরগুলিতে বিলি হয়। যতীন এই পুস্তিকাটি কলকাতায় ছাপিয়ে দলের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠান। তাঁর সহকর্মীদের সহায়তায় নির্ধারিত দিনে কলকাতাতেও বিতরণ হয়েছিল ইশতেহার 'বিপ্লবী'।

আরও পড়ুন
হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে খেটেছেন জেলও, বিস্মৃতির অতলে ভজহরি মাহাতো

বিপ্লবী দলের জন্য অস্ত্র এবং অর্থের ব্যবস্থাও করেন। তাঁর বন্ধু শিব বর্মার মতে, যতীন দাস ছোট রিভলভার, পিস্তল ইত্যাদি সংগ্রহে অত্যন্ত সফল একজন। সংগঠনটির অস্ত্রের প্রবল প্রয়োজন ছিল এক সময়। যতীন দাস কিছু ছুটকো ইউরোপীয় সংস্থায় লুটতরাজ চালিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই ছ'টি মাউজার পিস্তলের দু'টি সংগঠনটির বেনারস কেন্দ্রে এবং চারটি রামপ্রসাদ বিসমিলের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

আরও পড়ুন
আড়াই দশক ধরে উপেক্ষার শিকার মুম্বাইয়ের সাফাইকর্মীরা, প্রতিবাদে হয়েছে জেলও!

যতীন দাস পার্কে যতীন দাসের মূর্তি উন্মোচনের আগে শ্রীমতী প্রতিভা সান্যাল (শচীন্দ্রনাথ সান্যালের স্ত্রী) বলেছিলেন, ‘‘আমি যতীনকে তাঁর দলের দেওয়া ‘রবীন’ নামেই চিনতাম। যতীনকে প্রথমবার দেখে আমি আমার স্বামীর প্রতি তাঁর সমর্থ্য সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করলাম। তিনি কেবল বললেন, সময়ই বলে দেবে যে এই ছেলেটির মধ্যে কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা। আরো বলেছিলেন, রবীন এখনো পর্যন্ত তাঁর দক্ষতা খুব ভালোভাবেই প্রমাণ করেছে। এমন একটি দিন আসতে পারে যখন সারা বিশ্ব তাঁর নিঃস্বার্থ মানসিক দৃঢ়তা দেখতে পাবে... আমাদের জীবন খুব কঠিন ছিল। টাকা ছিল না। মাথার উপর ছাদ ছিল না। দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। ধীরে ধীরে রবীন সকলের প্রত্যাশা পূরণ করতে থাকেন। তিনি শুধু আমার স্বামীর সংগঠনের প্রাণ নয়, আমাদের পরিবারের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছিলেন। আমার এবং আমার সন্তানদের জন্য একটি বাড়ির ব্যবস্থাও পর্যন্ত করেছিলেন। এছাড়াও চারটি এমন নিরাপদ স্থান খুঁজে বের করেছিলেন, যেখানে আমার স্বামী লুকিয়ে সংগঠনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।’

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৮-২৯) আগেও যতীন দাস বেশ কয়েকবার জেলে গিয়েছিলেন। জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রথমবার গ্রেফতার করা হলে চারদিন কারাগারে রেখে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নেওয়ার শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯২১ সালের অক্টোবরে একটি মিটিংয়ে অংশ নেওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। এক মাসের কারাদণ্ডও ভোগ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার 'অপরাধে' তাঁর বিরুদ্ধে তিন মাসের কারাদেশ শোনায় ব্রিটিশ পুলিশ। কাকোরি ষড়যন্ত্র (১৯২৫) এবং দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলায় যতীন দাস চতুর্থবার গ্রেফতার হন। কিন্তু পুলিশ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেশ করতে না পারলে তাঁকে বেঙ্গল ক্রিমিনাল অর্ডিন্যান্সের অধীনে গ্রেফতার করে বাংলাতেই গৃহবন্দি করা। বেঙ্গল ক্রিমিনাল অর্ডিন্যান্সের অধীনে পুলিশ যেকোনো ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করতে পারত। তাছাড়াও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে দ্বিতীয় বিচারের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।

বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে যতীন দাসকে তিন বছর জেলে রাখা হয়। প্রথমে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে, তারপর সেখান থেকে তাঁকে মেদিনীপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মেদিনীপুরে প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন যতীন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কলকাতার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, তারপর ময়মনসিংহ কারাগারে (যা এখন বাংলাদেশে) পাঠানো হয়। ময়মনসিংহ জেলে যতীন দাস প্রথমবার রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন। জেল মহাপরিদর্শক নির্দেশ দিয়েছিলেন, যখনই একজন ব্রিটিশ অফিসার রাজনৈতিক বন্দির সেলের পাশ দিয়ে যাবেন, তিনি যেন উঠে এসে অফিসারকে সালাম দেন। এই বিষয়ে একদিন যতীন এবং ইন্সপেক্টর জেনারেলের মধ্যে তর্কাতর্কি। যার জেরে যতীনকে ব্যাপক মারধর করে ব্রিটিশ পুলিশ। এমনকী জেলে তাণ্ডব এবং অফিসারদের উপর হামলার অভিযোগে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে একটি চালান পেশ করা হয়। জেল কর্তৃপক্ষের এই বিদ্বেষপূর্ণ ও স্বেচ্ছাচারী আচরণের প্রতিবাদে যতীন অনশন শুরু করেন। ২১ দিন ধরে চলে সেই অনশন। ইন্সপেক্টর জেনারেল যতীন দাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর অনশন ভাঙেন যতীন। এরপর ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে তাঁকে পঞ্জাবের (বর্তমানে পাকিস্তানে) মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে ১৯২৮ সালের অক্টোবরে মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর পরই কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন চলাকালীন ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। যতীন দাসকে বিপ্লবীদের বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন ভগৎ। সহজেই এই অনুরোধ মেনে নেন যতীন।

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৮-২৯) যতীন দাস পঞ্চমবারের মতো গ্রেফতার হন। তাঁকে কলকাতা থেকে লাহোরে আনা হলে প্রথমে একদিনের রিমান্ডে রাখা হয়। এরপর রিমান্ড বাড়ানো হয় ১৫ দিন। এই রিমান্ডের সময়সীমা শেষ হলে তিনি জামিনের আবেদন করলেও আদালত তা নাকচ করে। ১৮ দিনের রিমান্ডের পরও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলে আদালত তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিলেও রাতারাতি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। বিশেষ জজ যতীন দাসকে জামিন দিতে অস্বীকার করেন।

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তকে দিল্লি জেল থেকে লাহোরে আনা হয়। লাহোর জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের অবস্থা দেখে এবং তাঁদের অধিকারের দাবিতে ভগৎ সিং ও দত্ত অনশন শুরু করেন। ১৩ জুলাই, যতীন দাস-সহ লাহোর ষড়যন্ত্রের বাকি অভিযুক্তরা ভগৎ ও বটুকেশ্বরের সমর্থনে অনশন ঘোষণা করেন। বিপ্লবীদের দাবি ছিল, তাঁদের ভালো খাবার, পড়ার জন্য সংবাদপত্র, শৌচ সুবিধা, পরবার ভালো কাপড় ইত্যাদি দিতে হবে। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের দাবি মানতে অস্বীকার করে কারাগারে ধর্মঘটরত বিপ্লবীদের দমন করতে সচেষ্ট হয়। অনশনের একাদশ দিন থেকে ধর্মঘট পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। ওই সময় জেল প্রশাসন বিপ্লবীদের জোর করে খাওয়ানোর জন্য কয়েকজন ডাক্তার ও সেনার একটি দল গঠন করে। এর পর বিপ্লবী এবং ডাক্তার-সৈনিকের মধ্যে খাওয়ানো এবং না খাওয়া নিয়ে প্রতিদিনের লড়াই শুরু হয়। দিন-দিন এর তীব্রতা বাড়তে থাকে।

এমনই পরিস্থিতিতে জেলের কর্মকর্তারা যতীন দাসের নাকে রাবার টিউব ঢুকিয়ে তাঁকে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির কারণে সেই নল তাঁর পেটে না গিয়ে ঢুকে যায় ফুসফুসে। ক্রমে যতীন দাসের শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তা সত্ত্বেও দাঁতে কিছুই কাটেননি। জলপান তো দূর, ওষুধ পর্যন্ত খাননি। এমনকী চিকিৎসা নিতেও রাজি ছিলেন না। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি অনশন ভাঙবেন না বলে অনড় ছিলেন। নির্মম ব্রিটিশ সরকারও জেদের উপর অনড় থাকে। ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯। যতীন দাস তাঁর অনশনের ৬৩ দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যখন মৃত্যুশয্যায় যতীন, পঞ্জাব বিধানসভার সদস্য এবং কংগ্রেস নেতা ড. গোপীচাঁদ ভার্গব দেখা করতে আসেন। ওষুধ ও জল খাচ্ছেন না কেন, ভার্গব এহেন প্রশ্ন করলে যতীন দাস বলেন, 'আমি মরতে চাই। আমাদের দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক বন্দিদের অবস্থার উন্নতি করা উচিত।’

যতীন দাস ৯৪ বছর আগে লাহোর জেলে রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে গিয়ে শহিদ হন। তখন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশদের গোলাম। আজ ভারত স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরও ভারতে রাজনৈতিক বন্দিদের চিকিৎসায় কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। বছর দুই আগে বর্ষীয়ান মানবাধিকার কর্মী জেসুইট পাদ্রি ফাদার স্ট্যান স্বামী (Stan Swamy) পুলিশ হেফাজতে প্রয়াত হন। অসুস্থতা সত্ত্বেও আদালত তাঁর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত ৮৪ বছর বয়সি স্ট্যান স্বামী খাবার জন্য 'স্ট্র' এবং 'সিপার' চেয়েছিলেন। এগুলি তিনি পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু প্রায় এক মাস পর। এমনকী তাঁকে শীতবস্ত্রের জন্যও আবেদন করতে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে 'মিথ্যে মামলা' সাজানো হয়েছে, তাঁর মতো একজন মানুষকে লাগাতার কারাবন্দি রাখা অমানবিক বলে বিরোধীরা রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ পর্যন্ত দাবি করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু আদিবাসীদের অধিকারের হয়ে আন্দোলনকারী স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়েছিল বম্বে হাইকোর্টে জামিনের শুনানির আগেই। যতীন দাস থেকে ফাদার স্ট্যান, রাজনৈতিক বন্দিদের অবস্থা খুব বিশেষ বদলায়নি।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor