সারা জীবন ‘ভাঁড়ামি’ করেই কাটিয়েছেন, আক্ষেপ ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর

পাণ্ডিত্যের সঙ্গে প্রগাঢ় রসবোধ সঠিকভাবে মিশে গেলে যে মিঠেকড়া সন্দেশ তৈরি হয়, সৈয়দ মুজতবা আলীর (Syed Mujtaba Ali) সাহিত্যচর্চা অনেকটা সেরকম। দেশ-বিদেশ ঘোরার বিচিত্র অভিজ্ঞতা লিখে যেতেন সাবলীল আড্ডার মেজাজে। তথ্যে পরিপূর্ণ, অথচ বদহজমের উদ্‌গার ওঠে না একেবারেই। হরেক রকম ভাষায় সমান দক্ষ, গল্প করার সঙ্গী পেলে তাঁকে থামানো হত মুশকিল। আবার ধর্ম ও দর্শনের সাধনায় উদার সংকীর্ণতাবাদী চর্চার জন্য পিছু ছাড়েনি কটাক্ষ। বাংলা সাহিত্যের দরবারে এমন সুস্বাদু পঞ্চব্যঞ্জন পরিবেশনের কৃতিত্ব মুজতবা আলী ছাড়া আর কজনেরই বা আছে?

‘রান্না’র কাজে হাত পাকানো শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতন থেকে। তাঁর জন্ম ১৯০৪ সালে সিলেটে। বাবা ছিলেন সাব-রেজিস্ট্রার। বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদে প্রায়ই ঘুরতে হত বিভিন্ন জায়গায়। ‘দেশে-বিদেশে’-র প্রকৃত সূত্রপাত যেন হয়ে গেছিল এই ঘোরাঘুরির মধ্যেই। স্কুল শেষ হল, ১৯২১-এ ভর্তি হন বিশ্বভারতীতে। তখন সদ্য গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের বিশ্বভারতী। কলকাতা থেকে বহুদূরে, ছাত্রসংখ্যাও কম। তার মধ্যে এক মুসলিম ছাত্রকে ভর্তি করা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু একা হাতে সমস্যার সমাধান করলেন গুরুদেব। সেখানে ছাত্র থাকাকালীন একবার রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন কী শিখতে চাও? স্পষ্ট উত্তর ছিল না আলী সাহেবের কাছে। জানালেন, কোনো একটা জিনিস অত্যন্ত ভালোভাবে শিখতে চান। কিন্তু একটার বদলে অনেকগুলো জিনিস শিখলে সমস্যা কী? এই উৎসাহই তাঁকে আজীবন প্রেরণা জুগিয়েছে বহু ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার।

১৯৩১ সালের কথা। ছাত্রাবস্থা শেষ হয়েছে বহুদিন। বরোদার কলেজে পড়াচ্ছেন ধর্মশাস্ত্র। একদিন ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। সাক্ষাৎ হল গুরুদেবের সঙ্গে। অবশ্যই তিনি ছাত্রদের সাফল্যে গর্বিত, কিন্তু কিছুটা আক্ষেপ কি ঝড়ে পড়ল কণ্ঠে? কৃতী ছাত্রদের শান্তিনিকেতনে ডেকে আনার মতো সামর্থ্য কোথায়? তারপরই করে ফেললেন এক অদ্ভুত প্রশ্ন। সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি নিয়ে? আলী সাহেবও অবাক। মহাপুরুষ তো আসে শঙ্খ, চক্র, গদা-পদ্ম নিয়ে, কাঁচি হাতে তিনি কী করবেন? রবীন্দ্রনাথ জানালেন, তাঁকে আসতে হবে কাঁচি নিয়েই। কেটে দেবেন সামনের দাঁড়ি, পিছনের টিকি। সব চুরমার করে হিন্দু-মুসলমান এক করে দেবেন। 

এই শিক্ষা নিয়েই জীবন ও সাহিত্যের শুরু মুজতবা আলীর। একবার এক হিন্দু প্রকাশকের বাড়ির শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ এসেছে। স্নান করে, শুভ্র বস্ত্রে পৌঁছোলেন সেখানে। শ্রাদ্ধের কাজ তখনও কিছু বাকি। আলী সাহেব পুরোহিতদের কাছে গিয়ে ধর্মীয় পরিচয় দিলেন। তারপর বিনীত কণ্ঠে চাইলেন গীতাপাঠের অনুমতি। পুরোহিতরা কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েই জায়গা করে দিলেন একপাশে। সবাই ভাবছেন, এবার হয়তো একটি গীতা তিনি চেয়ে নেবেন কিংবা পকেট থেকে বের করবেন। সেসব কিছুই হল না। চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থভাবে শুরু করলেন গীতার একাদশ অধ্যায়। এমনই ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের কয়েক হাজার গান তাঁর সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল।

আরও পড়ুন
মুজতবার ভ্রমণ, নেতাজি-অন্তর্ধান থেকে ‘বাঙালি বউ’-এর হত্যা : কাবুলের বঙ্গ-যোগ

এভাবেই আজীবন ঘৃণা করে এসেছেন সংকীর্ণ ধর্মীয়চেতনাকে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে আরও দৃঢ় হয়েছে ধর্মীয় উদারতা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুজতবা আলী কলকাতায়, স্ত্রী-সন্তান পূর্ব-পাকিস্তানে। তিনি উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত খবর এল বিদেশ ঘুরে। সঙ্গে আসতে শুরু করেছে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল। নির্মল সেনগুপ্তের স্মৃতিকথা অনুযায়ী ক্লান্ত, বিষণ্ণ আলী সাহেবের গলায় বাসা বাঁধে খেদোক্তি, “আমার গবেষণার বিষয় ধর্ম। পড়তে গিয়ে বুঝেছি ধর্ম শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, তার চর্চাও ধর্ম, এবং সেই ধর্মপালনের মধ্য থেকেই চেনা যায় সেই ধর্মকে যা লোকসাধারণের ব্যবহার।... অথচ ধর্ম সম্বন্ধে এই দৃষ্টি দিয়ে প্রামাণিক একখানা বই লিখলাম না, সারা জীবন ভাঁড়ামি করেই কাটালাম।”

আরও পড়ুন
‘শান্তিনিকেতনে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব’, চাকরি ছাড়ার নোটিশে অপমানিত মুজতবা আলী

কতটা আত্মবিশ্লেষণী শক্তি থাকলে তাঁর মতো একজন সারা জীবনের সাহিত্যকর্মকে অনায়াসে ‘ভাঁড়ামি’ বলে দিতে পারেন। হিন্দুধর্মের সাক্ষাৎ পরিচয় পেয়েছেন এদেশে, ব্রাহ্মধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছেন শান্তিনিকেতনে। ইসলামকে দেখেছেন এখানে ও মধ্যপ্রাচ্যে। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিতে দেখেছেন খ্রিস্টানধর্মকে। লোকজীবনের মধ্যে কোথাও একটা মিল তো দেখেছিলেন, যার প্রকাশ পেল না বলে তাঁর আক্ষেপ। 

জার্মানির কথা যখন উঠলই, তখন একবার ঘুরে আসা যায় নাৎসি আমলে। ১৯৩৪-এ তিনি ছিলেন সেখানে। পরে হিটলারকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থও লিখেছেন। তাঁর মতে হিটলার প্রেম করেছিলেন একটা পুরো, আর দুটো ‘হাফ’। কীরকম ব্যাপারটা? প্রথম ‘হাফ’টি ছিল ‘ঝুলে ঝুলে মরা’ কৈশোরের বাছুরের প্রেম। তারপর গেলি রাউরালের প্রতি ‘পাক্কা’ ভালোবাসা। যার জন্য নাকি আত্মহত্যাও করতে গেছিলেন হিটলার। আর শেষ ‘হাফ’টি এফা ব্রাউনের সঙ্গ। এই মহিলার সম্মানরক্ষার্থে কিন্তু আলী সাহেব লড়ে গেছেন তাঁর সাহিত্যে। আবার হিটলার চরিত্রে নৃশংসতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন দুর্বলতাগুলিকেও। ‘শবনম’-এর সাহিত্যিকের হাতে একতরফা থাকেন না কোনো চরিত্রই।

জীবন সম্পর্কেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এইরকম। একদিকে তীব্র হাসির কলরোল, অন্যদিকে কথাবার্তায় স্পষ্টবাদী। দিতে হয়েছে নিরপেক্ষতার মাশুলও। কিন্তু সাহিত্যে আঁচ পড়তে দেননি ব্যক্তিগত উষ্মার। সেখানে তিনি বাঙালির চিরপরিচিত গল্পবাজ ‘চাচা’। ‘দেশে বিদেশে’, ‘জলে ডাঙায়’-এর ভ্রমণকাহিনি ছাড়াও ‘চাচা কাহিনী’, পঞ্চতন্ত্র’-এর মতো রম্যরচনায় উজাড় করে দিয়েছেন প্রতিভার ঝুলি। সঙ্গে আছে কয়েকটি উপন্যাস, ছোটোগল্প ও প্রবন্ধের বিরাট সংকলন। ছোটোবেলায় তাঁর নাম ছিল ‘সিতারা’। যার অর্থ নক্ষত্র। ভালোবেসে অনেকে ডাকতেন ‘সীতু’ বলে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি আজও নক্ষত্রের মতো বিরাজমান।

তথ্যঋণ : মজলিশি মুজতবা, তাপস ভৌমিক সম্পাদিত
পথে চলে যেতে যেতে, রমা চক্রবর্তী
রচনাবলী ১, সৈয়দ মুজতবা আলী

Powered by Froala Editor