সিনেমা, মহাশ্বেতাদি, মুজতবা আলী

চলচ্চিত্র সাংবাদিক— সিনে জার্নালিস্ট যদি শুধুমাত্র বলি, তাহলে মৃগাঙ্কশেখর রায় ও প্রদীপ্ত সেনকে ‘তুরুশ্চু’ করা হবে নেহাৎই। এঁরা দুজনেই কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিপুরুষ। বিশেষ করে প্রদীপ্ত সেন। তখন কলকাতায় ‘সিনে সেন্ট্রাল’-এর খুব রমরমা। ‘চিত্রবীক্ষণ’ ও ‘চিত্রভাষ’ নামে দুটি অতি সিরিয়াস ফিল্মের পত্রিকা বেরয় এই শহর থেকেই। ‘এক্ষণ’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় ছাপা হয় সত্যজিৎ রায়ের করা চিত্রনাট্য। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের নিজের সিনেমার স্ক্রিপ্ট যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ‘বাক্সবদল’-এর চিত্রনাট্য, যা সত্যজিৎ রায়ের করা। ‘বিভাব’ পত্রিকা— আরতি সেনগুপ্ত সম্পাদিত সাহিত্য বিষয়ক— শুধু সাহিত্য কেন, শিল্প-সাহিত্যের নানা অলিন্দে ঘোরাফেরা করা বিভাব-এ বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বেশ কয়েকটি চিত্রনাট্য ছাপা হয়েছে। ‘বিভাব’ সমরেন্দ্রদাই— পঞ্চাশের বিশিষ্ট কবি ও হৃদয়বান সমরেন্দ্র সেনগুপ্তই সম্পাদনা করতেন। সম্পাদক হিসাবে নাম ছাপা হত আরতি বৌদির। হয়তো সমরেন্দ্রদার অফিস ইত্যাদি নিয়ে কোনো অসুবিধা ছিল। বেসরকারি কোম্পানিতে বড়ো চাকরি করতেন সমরেন্দ্রদা। পার্ক সার্কাসের কাছাকাছি অঞ্চলে তাঁর বাড়ি বহুবার গেছি ‘যুগান্তর’-এর নোনাপুকুর-এর বাড়ি থেকে, হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে কথাকার প্রফুল্ল রায়ের সঙ্গে। ‘কফি হাউসের সিঁড়ি’, ‘আমার সময় বড় কম’ ইত্যাদি প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থের লেখক সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর সহজীবনের মানুষ আরতি সেনগুপ্ত অতি চমৎকার মানুষ। আমি চা খাই না বলে আমার জন্য ‘হরলিকস’-এর ব্যবস্থা থাকবেই। ‘বিভাব’-এ লিখলে অর্থও পাওয়া যেত। গল্প লিখলে পঞ্চাশ টাকা। আমি আশির দশকের কথা বলছি। তখনকার দিনে পঞ্চাশ টাকার দাম অনেক। ‘বিভাব’ ছাড়াও লিখলে পয়সা— সম্মান দক্ষিণা দিতেন ‘প্রমা’ সম্পাদক কবি সুরজিৎ সেনগুপ্ত। তিরিশ টাকা পাওয়া যেত গল্প লিখলে, আশির দশকে। সুরজিৎদাদের বড়োসড় ভাড়াবাড়ি বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাছে। আমি যখন কবি, প্রাবন্ধিক, স্মৃতিধর সুরজিৎ ঘোষকে দেখি, তখন তাঁর বাড়িতে কাকা আছেন, মা-বাবা। জয়তী বৌদির সঙ্গে সুরজিৎদার ডিভোর্স হয়ে গেছে ততদিনে। সুরজিৎ ঘোষ নাটকেরও মানুষ ছিলেন। বুধসন্ধ্যার লেখকদের সংগঠন ‘বুধসন্ধ্যা’-র নাটকের তিনি ছিলেন পরিচালক। সুরজিৎদা-জয়ন্তী বৌদির কন্যা তিতলিও তখন সেই বাড়িতে, বাবা-ঠাকুমা-ঠাকুর্দার সঙ্গে। সুরজিৎদার বাবা ঢাকার মানুষ। ঢাকা ‘এরিয়ান’ ক্লাবে তিনি খেলতেন নিয়মিত ফুটবল। বিনয়-বাদল-দিনেশের ‘রাইটার্স অভিযান’-খ্যাত বিপ্লবী বিনয় বসু ছিলেন তাঁর সহপাঠী। খুব রঙদার মানুষ। নানান গল্পের স্মৃতি তাঁর কাছে। বলতেনও। মাথা জোড়া টাক সুরজিৎদার বাবা ও কাকার। কাকা কালো, তুলনায় বাবা অনেকটাই ফরসা। প্রায় বারো মাসই সুরজিৎদার কাকাকে খালি গা, সুতির রঙিন লুঙ্গি, হাতে ঘড়ি পরা অবস্থাতে দেখেছি। বাবা ধুতি-শার্ট, বাইরের কেউ এলে। সুরজিৎদার মা লম্বা, সুন্দর মুখ। শ্রীকপালে সিঁদুরটিপ। সর্বদা গালে পান। মাসিমা গেলেই কিছু না কিছু খেতে দিতেন। সুরজিৎদারা ঢাকার, বর্ধিষ্ণু কায়স্থ। আমার বিবাহের পর আমাকে আর শুভ্রাকে বাড়িতে ডেকে মাসিমা শাড়ি, রুপোর সিঁদুর কৌটো দিয়েছিলেন শুভ্রাকে। সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তখনও আমার ‘যুগান্তর’-এর চাকরি ‘পাকা’ হয়নি। অবশ্য ‘যুগান্তর’-এ কবেই বা পাকা চাকরি হল আমার? মাসিমা— সুরজিৎ জননী অসম্ভব স্নেহশীলা। আজও তাঁর মুখখানা চোখের সামনে ভাসে— ভেসে ওঠে। সুরজিৎ ঘোষের ডাক নাম ছিল ভঙ্কু। মাসিমা খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই নাম ধরে বাড়িতে ডাকতেন সুরজিৎদাকে। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর বহু তরুণের বই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের টাকায় ছাপা হয়। সরকারি অনুদান। সেই সরকারি অনুদান ফর্ম জোগাড় করে দিয়েছিলেন সুরজিৎ ঘোষ। আমার প্রথম গল্প সংকলন ‘রথযাত্রা’ প্রকাশিত হয় ‘প্রমা’ থেকে, অবশ্যই সরকারের দেওয়া টাকায়। এই গ্রন্থের মলাট এঁকেছিলেন সহকর্মী সোমনাথ ঘোষ। তখন পাক্ষিক ‘প্রতিক্ষণ’-এ ছশো টাকা মাইনের চাকরি করি। মাস ফেলে ছশো। গল্প সংকলন ‘রথযাত্রা’ প্রকাশিত হওয়ার আগে আমার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, উপন্যাস— ‘কাছেই নরক’, যা আমার জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা, প্রকাশক ‘নয়ন প্রকাশনী’। কলেজস্ট্রিটের সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটে নয়ন প্রকাশনীর ছোটো অফিস। প্রকাশন সংস্থার মালিক অনিমেষ চক্রবর্তী। ‘কাছেই নরক’ প্রকাশের আগে অনিমেষ আমায় দুশো টাকা অগ্রিম দেন। সেই সময়টা ১৯৮০-৮১ সাল। দুশো টাকা আমি হেন নানা জায়গায় ‘খুঁটে খেয়ে বেড়ানো জনের’ কাছে অনেক, অনেক। অনিমেষ চমৎকার মানুষ ছিলেন। ভদ্র, পরিশীলিত। পরে কবি কার্তিক মোদকের পরামর্শে প্রতি জেলার কবিতা সংকলন, সেই জেলার অন্যতম প্রধান নদীর নামে করতে গিয়ে আর্থিকভাবে একদম ডুবে যান। নদীয়ায় কবিদের কবিতা দিয়ে শুরু হয়, নাম হয় ‘চূর্ণী’। সম্ভবত একটাই খণ্ড বেরিয়েছিল। ব্যস। তারপর বন্ধ সেই খণ্ডে খণ্ডে জেলাভিত্তিক কবিতা সংকলন ছাপার কাজ। অনিমেষও ধীরে ধীরে তাঁর প্রকাশনা সংস্থার ব্যবসা গুটিয়ে জ্যোতিষী হয়ে উঠলেন, পেশাদার জ্যোতিষী। পরে জেনেছি, ভালো রোজগার তাঁর। এখবর অবশ্য লোকমুখে। একবারই মাত্র দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে প্রকাশনা সংস্থা বন্ধ করে দেওয়ার পর। ‘নয়ন’ প্রকাশনী থেকে ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের ‘সোভিয়েত দেশ— সাংবাদিকের দৃষ্টিতে’ ছাপা হয়েছিল। তার আগে প্রশান্তদা গেছিলেন লিওনিদ ব্রেজভের সোভিয়েত ইউনিয়নে। ছিলেন দিন আট দশ। ‘কাছেই নরক’-এর প্রথম সংস্করণের মলাট এঁকেছিলেন প্রবীর সেন। একগাল কাঁচা— কালো দাড়ি নিয়ে তখন তিনি নিয়মিত আড্ডা মারতে আসেন ‘কথা ও কাহিনী’-তে, অবনীবাবুর ‘কথাশিল্পী’-তে। তখনও ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় চাকরি হয়নি। তখনও তিনি সুব্রত চৌধুরী, তাপস কোনাররা যেমন সাপ্তাহিক, শারদীয় ‘অমৃত’ পত্রিকায় গল্প-উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন করেন ফ্রিলান্সার হিসাবে। সুব্রত চৌধুরীর আঁকায়— ইলাস্ট্রেশনে পুলক ধরের প্রভাব যথেষ্ট। ফিগারের কপাল সামান্য উঁচু। প্রবীর সেন বাংলা গদ্যটাও বেশ ভালো লিখতেন। মৃগাঙ্কশেখর রায় আর প্রদীপ্ত সেনকে দিয়ে এই লেখার মুখপাত শুরু হয়েছিল। মৃগাঙ্কশেখর রায়ের হাতের নখ খাওয়ার বাতিকের কথা আগেই বলেছি। তাঁর আশেপাশে থাকা ঘনিষ্ঠজন তাঁর পেছনে— আড়ালে ‘নখখেকো’ বা ‘নখখেগো’ বলতেন। এমনও বলতেন তাঁরা কেউ কেউ— নখন খেতে খেতে নাকি মৃগাঙ্কশেখর রায় তাঁর হাতের কনুই পর্যন্ত খেয়ে ফেলেন। তখন পিজি হাসপাতাল— এসএসকেএম-এর উল্টোদিকে সরলা মেমোরিয়াল হল। সেখানে নানাধরনের চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসব ছাড়াও রেট্রো— রেট্রোস্পেকটিভ। পূর্ব ইউরোপের ছবি, আনসেনসরড ছবি, জঁ লুক গোদারের সিনেমা— সবই তো ‘সরলা মেমোরিয়াল’-এর পরম ঠাসা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে। সেই সিনেমা দর্শনের ম্যাজিকই তো আলাদা। মৃগাঙ্কশেখর রায়, প্রদীপ্ত সেন— দুজনেই ‘ফিল্ম বাফ’। মৃগাঙ্কশেখরের চলচ্চিত্র বিষয়ক বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-য়। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তো বটেই। ফেস্টিভ্যাল ছাড়াও। এসব লিখতে লিখতে ‘প্রমা’ সম্পাদক কবি সুরজিৎ ঘোষ বিষয়ে একটা কথা মনে পড়ল। তখন ‘দৈনিক বসুমতী’-তে কিছু কিছু আর্ট রিভিউও করি। এরকমই কোনো ছবির প্রদর্শনী দেখতে গেছি আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে। শীতের বিকেল। ময়দান জুড়ে সন্ধে নামব নামব সময়। যে এগজিবিশন দেখতে গেছি, সেখানে সুরজিৎদা— সুরজিৎ ঘোষ। অ্যাশ কালারের স্যুট— শ্যু পরা। পাশে একজন ফর্সা, বিড়ালাক্ষী নারী। তেমন লম্বা নন। সুরজিৎদা ফ্রেঞ্চকাট— গোটি, মাথা জোড়া টাক। সুরজিৎদাই আলাপ করিয়ে দিলেন আমার প্রাক্তন স্ত্রী— জয়তী। জয়তী বৌদি বা জয়তী— যাই বলি না কেন তাঁকে, তখন বিবাহিত-পুনর্বিবাহ। আমি জানি। তাঁর পরনে কালোর ওপর ববি প্রিন্টের শাড়ি। শাড়িটা সিন্থেটিক। তেমন লম্বা নন। কিন্তু চেহারায় আকর্ষণ আছে। তারপরও দু-একবার দেখা হয়েছে, জয়তীদি বা জয়তী বৌদির সঙ্গে। তিনি তো অভিনয় করতেন বাংলা নাটক, বাংলা সিরিয়ালও করেছেন কয়েকটা। একটি বড়োই রোল। নিজে নাটকও পরিচালনা করেছেন। ‘প্রমা’ ত্রৈমাসিক ছিল— ওয়ান এইটথ ডিমাই সাইজ। পরে মাসপত্র হয়ে ‘প্রতিক্ষণ’ সাইজ হল। সেই কাগজে একটা কলাম লিখতাম ‘বইয়ের জানালা’ নামে, কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার নিত্য খবর, বই প্রকাশ ইত্যাদি নিয়ে। পরে দেখলাম পাক্ষিক ‘দেশ’ ‘বইয়ের জানালা’ নামটি নিয়েছে। তাদের নিয়মিত ফিচার হেডিং হিসাবে। সুরজিৎদা প্রতি মাসে ‘বইয়ের জানালা’ বাবদ আমাকে কুড়ি টাকা দিতেন। ত্রৈমাসিক ‘প্রমা’-র এডিটোরিয়াল বোর্ড ছিল। আমার ব্যক্তিগত মতামত মাসপত্র ‘প্রমা’-র থেকে ত্রৈমাসিক প্রমা অনেক sঅনেক গুণ সম্পন্ন কাগজ ছিল। এই ত্রৈমাসিকপত্রের বিশেষ সংখ্যায় ভোজপুরের কৃষক সংগ্রাম নিয়ে ‘মাস্টারসাব’ লিখেছিলেন মহাশ্বেতাদি। আবার মহাশ্বেতাদির ‘টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা’ বেরয় মাসপত্র ‘প্রমা’-তে। ‘প্রস্তুতি পর্ব’-র কথা আগেই বলেছি। কি চমৎকার লিটল ম্যাগাজিন ছিল ‘প্রস্তুতি পর্ব’। র‍্যাডিক্যাল এই পত্রিকাটি বেরত, কথাশিল্প থেকে, যে তথ্য আগেই দিয়েছি। তখন ‘অনুষ্টুপ’-ও অন্যরকম ছিল। আসলে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতে ‘এক্ষণ’, ‘পরিচয়’-এর যে মনোপলি— একচেটে বৌদ্ধিক ব্যাপার, তা খানিকটা ভাঙতে পেরেছিল ‘প্রমা’, ‘অনুষ্টুপ’, ‘প্রস্তুতি পর্ব’, ‘অনীক’। বহরমপুর থেকে প্রকাশিত ‘অনীক’-এর সম্পাদক ছিলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী ও রতন খাসনবিশ। তাঁদের কল ছিল এসআর— সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, প্রথম দিকে। ‘অনীক’ অবশ্য ‘র‍্যাডিক্যাল’ পত্রিকাই। চিনের বিষয়ে নানা তথ্য আমরা পাই ‘অনীক’-এ। ‘অনীক’-এ রাজনৈতিক প্রবন্ধই প্রধান। তবে গল্প, কবিতাও থাকত। তাদের প্রকাশন সংস্থা পিপলস বুক সোসাইটি— পিবিএস। রতন খাসনবিশ  ও দীপঙ্কর চক্রবর্তী— দুজনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ আলাপ। রতন খাসনবিশ আমাদের যে মার খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যাত্রা ২০১১-এর পর থেকে— কামদুনি, গেদে, ভাবদিঘি, মধ্যমগ্রাম, পার্কস্ট্রিট, কেশপুর স্বরূপনগর— সেখান কয়েকটি অভিযানে তিনি গেছেন। আমরা যেতাম মূলত পশ্চিমবঙ্গ— রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য ভারতী মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে। কোথায় কোথায় না চলে গেছি তখন প্রাণ হাতে করে প্রায়। হয়েছি মৃত্যুর মুখোমুখি। কতবার গেছি ভাঙরে— পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে। জীবন গেছে এভাবেই। পিবিএস থেকে চিং চিং মাইকের ‘বিপ্লবের গান’ বেরয় সত্তর দশকে। মলাট এঁকেছিলেন অনুপ রায়। সেই মলাটে একটি গতিময় ঘোড়ার ছবি— এখনও মনে আছে। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘ম্যানিফেস্টো’ সত্তর দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত হত। পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের নামের বানান পার্থ বন্দোপাধ্যায় লিখতেন। কেন লিখতেন জানি না। এই পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম কলেজস্ট্রিট কফি হাউসের সিঁড়িতে আমাকে বলেন, আপনি কিন্নর রায় না? উত্তরে হ্যাঁ বলতেই তিনি বলেন, মহাশ্বেতাদি আপনাকে খুব খুঁজছেন। তার আগে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ‘অপারেশন বসাই টুডু’ বেরনোর পর আমি একটি চিঠি লিখেছিলেন ‘অপারেশন বসাই টুডু’-র পাঠ প্রতিক্রিয়া। সেই চিঠি ‘কৃত্তিবাস’ ছাপে। চিঠি পড়েই মহাশ্বেতাদি আমাকে খুঁজতে থাকেন। ‘বায়োস্কোপের বাক্স’, ‘বিবেক বিদায় পালা’, ‘ঝাঁসির রানি’-র বাইরে এ এক অন্য মহাশ্বেতাকে আবিষ্কার করি যেন। তারপর তো মহাশ্বেতার বাড়ি যাওয়া, তখন তিনি বালিগঞ্জ স্টেষনের কাছে জ্যোতির্ময় বসুর ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। সিপিআই (এম) সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু। যিনি লোকসভায় ‘মারুতি কেলেঙ্কারি’-সহ নানা বিষয়ে অসামান্য বলতেন, তথ্য-প্রমাণাদি সহ। জ্যোতির্ময় বসুকে ‘অরণ্যদেব’ বলতেন মহাশ্বেতা। তাঁর এই দোতলায় কত কত জনকে দেখেছি। স্বামী অগ্নিবেশ, তখন তিনি এমপি ও বান্ধুয়া মজদুর— বন্ডেড লেবারদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করছেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফ্রন্টিয়ার সম্পাদক তিমির ঘোষ, এরকম অনেকেই। সত্তর দশকের শেষ দিকে তাঁর বাড়িতে র‍্যাডিক্যাল রাজনীতির বহু মানুষজনকে দেখেছি। আবার লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক, প্রকাশক— তাঁরাও। প্রমা সম্পাদক সুরজিৎ ঘোষ, আইপিএফ— ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টের অধ্যাপক অরিজিৎ মিত্র, এমসসি— মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আত্মগোপনকারী নেতৃত্ব। পরে মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেম্মটারের লোকজনের কথা শুনেছি মহাশ্বেতাদির কাছে। প্রায় সমস্ত ধরনের র‍্যাডিক্যাল গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী তিনি— তিনি মহাশ্বেতা, মহাশ্বেতা দেবী— মহাশ্বেতাদি। এসব নিয়ে পরে পরে অনেক অনেক বিস্তারে বলা যাবে। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত— কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর দোতলা বড়ো বাড়ির খুব কাছে থাকতেন সৈয়দ মুজতবা আলী। আলী সাহেবের বহু গল্প কথা শুনেছি সমরেন্দ্রদা— সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কাছে। তিনি সবুজ কালিতে লিখতেন, এত সবাই প্রায় জানে। বহুভাষী, রসিক, প্রকৃত পণ্ডিত আর একই সঙ্গে জীবনরসিকও বটে— সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর রঙিন জীবনের রংদারিতে মুগ্ধ করেছেন আমাদের অনেককেই। সেইসব লেখা— দেশেবিদেশে, চাচাকাহিনী, শবনম, ময়ূরকণ্ঠী, শহর এ ইয়ার, হিটলার, দ্বন্দ্ব-মধুর, কি ভাষা কি ভাষা! রম্য রচনার ভাষা যে কী হতে পারে, তা যেন ঠিক করে দিলেন সৈয়দ মুজতবা আলি নিজের কলমটানে।

Powered by Froala Editor