হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে খেটেছেন জেলও, বিস্মৃতির অতলে ভজহরি মাহাতো

পুরুলিয়ার (Purulia) বান্দোয়ান থানার অন্তর্গত ছোট্ট গ্রাম জিতান। সবমিলিয়ে মাত্র ৯০০ মানুষের বাস সেখানে। মূলত চাষাবাদেই সংসার চলে তাঁদের। আর পাঁচটা স্থানীয় বাড়ির মতোই সেখানে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। মাটির দেওয়াল, টিনের ছাদ। চিহ্নমাত্র নেই আড়ম্বরের। অথচ, এই বাড়িতেই নাকি বাস করতেন সে-জেলার এক অন্যতম সাংসদ এবং বঙ্গদেশের এক স্বাধীনতা আন্দোলনকারী।

ভজহরি মাহাতো (Bhajahari Mahato)। ১৯৩০-এর আন্দোলনই হোক কিংবা ৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্রিটিশ অধ্যুষিত বান্দোয়ান থানা দখল—  মানভূম অঞ্চলে জাতীয় কংগ্রেসের প্রায় সমস্ত আন্দোলনেই সামিল ছিলেন ভজহরি। এমনকি বান্দোয়ান থাকা দখলের সময়, একাধিক শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেসি নেতা কারাবন্দি থাকায়, নিজের বাড়িতেই জাতীয় কংগ্রেসের সভার আয়োজন করেছিলেন খোদ ভজহরি। তবে এই গল্প স্বাধীনতা আন্দোলনের নয়। বরং, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ের। আসলে দেশ স্বাধীনের পরেও আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে যাননি তিনি। বা বলা ভালো, নিস্তার পাননি অবিচার থেকে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য নতুন করে ফের নামতে হয়েছিল লড়াই-এর ময়দানে। সেটা কেমন?

১৯৪৭ সাল। ব্রিটিশ শাসকদের থেকে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে গেলেও, ভারতের অভ্যন্তরীণ মানচিত্র তখনও আজকের মতো ছিল না। ২৮টির বদলে তখন মাত্র ৪টি রাজ্য ছিল ভারতে। পরবর্তীতে সেগুলিকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে ছোটো ছোটো রাজ্য তৈরি করা হলেও, সেই রাজ্যগুলি ভাষাভিত্তিক ছিল না মোটেই। যেমন অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের কথাই ধরে নেওয়া যেতে পারে। অঞ্চলটি একসময় মাদ্রাজ-প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত হওয়ায়, সেটিকে রাখা হয়েছিল মাদ্রাজকেন্দ্রিক রাজ্যের অভ্যন্তরে। ঠিক সেভাবেই বাংলাভাষী পুরুলিয়া তথা মানভূম অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বিহারে। আর সেখান থেকেই সূত্রপাত বিতর্কের।

অভিযোগ উঠতে শুরু করে, বিহার সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দিভাষা। বিহার সরকারের এই পদক্ষেপের পরই জাতীয় কংগ্রেস ছেড়ে পৃথক দল গঠন করেন মানভূমের একাধিক কংগ্রেসী স্বাধীনতা আন্দোলনকারী। যাঁরা গান্ধীজির আদর্শেই লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ‘লোকসেবক সংঘ’— সদ্য-স্থাপিত এই দলটিরই অন্যতম সদস্য ছিলেন ভজহরি মাহাতো।

গান্ধীজির আদর্শে দীক্ষিত ভজহরি ভরসা রেখেছিলেন অহিংস আন্দোলনেই। হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন সত্যাগ্রহ, টুসু গান, ছৌ নাচকে। কখনও আগ্রাসন-বিরোধী অবস্থানে, মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। কখনও আবার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে টুসু গান গেয়ে রব তুলতেন প্রতিবাদের—

“শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ভাঙ্গ দেখাই
তোরা আপনি তরে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই
ভাইকে ভুলে করলি বড়ো
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই
বাঙ্গালিকে মারলি তবু
বিষ ছড়ালি— হিন্দি চাই” 

এই প্রতিবাদের জেরেই, স্বাধীন দেশে একাধিকবার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে থিতিয়ে পড়েনি আন্দোলন। বরং, তাঁর লেখা গানই সে-সময় ঝড় তুলেছিল গোটা মানভূমে। এমনকি বাধ্য হয়ে টুসু গান নিষিদ্ধ করেছিল বিহার সরকার।

১৯৫৪ সালে এই সমস্যার সমাধান করতেই এগিয়ে আসেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়। বাংলা এবং বিহারকে একত্রিত করে যুগ্মপ্রদেশ তৈরির আর্জি জানান কেন্দ্র সরকারের কাছে। তবে এই প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দিয়েছিল ভজহরি মাহাতোর দল। তার কারণও খুব স্পষ্ট। যুগ্মপ্রদেশ তৈরি হলেও যে ভাষা আগ্রাসনের সুরাহা হবে না মানভূমে। বরং, আরও কোণঠাসা হয়ে উঠবে মাতৃভাষা বাংলা। পরে অবশ্য বিধানচন্দ্রের এই আর্জি খারিজও হয়ে যায় কেন্দ্র থেকে।

১৯৫৬ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ফের বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ভজহরি। মানভূমিকে বাংলায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে, গান-মাদলকে হাতিয়ার করে পদযাত্রার মাধ্যমেই পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। হ্যাঁ, জয় হয়েছিল শেষ অবধি। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ১ নভেম্বর, ১৯৫৬। মানভূমের ১৬টি থানা নিয়ে তৈরি করা হয় পুরুলিয়া জেলা। তা অন্তর্ভুক্ত হয় পশ্চিমবাংলায়। যদিও রাঙা মাটির বেশ কিছু অঞ্চল, বিশেষত শিল্পাঞ্চল নিজের দখলেই রাখে বিহার। তবে ভজহরির এই আন্দোলন যে বাংলা ভাষাকে এবং একাধিক আঞ্চলিক উপভাষাকে স্বতন্ত্রভাবে বাঁচার আশ্রয় খুঁজে দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।

পুরুলিয়া রাজ্য গঠনের পর দু’বার সাংসদ হিসাবে নির্বাচিতও হয়েছিলেন ভজহরি মাহাতো। জেলায় তৈরি করেছিলেন একাধিক বিদ্যালয়। তবে যাপনে পরিবর্তন আসেনি কোনো। ভাঙা সাইকেল নিয়েই জেলার এ-গ্রাম ও-গ্রাম ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত তাঁকে। পরনে ময়লা ধুতি, পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। উপার্জনের রাস্তা বলতে ছিল চাষাবাদ। আর বিনোদন বলতে ছৌ ও টুসু।

২০০৩ সালে ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হন কিংবদন্তি টুসুশিল্পী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষাবিদ এবং প্রাক্তন সাংসদ। তবে বাংলা কিংবা ভারতের ইতিহাস কি আদৌ তাঁকে মনে রেখেছে? হয়তো না। গোটা পুরুলিয়া-জুড়েও তাঁর একটি মাত্র মূর্তি টিমটিম করে জ্বলে রয়েছে সিধু-কানহু-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্থানীয় মানুষদের স্মৃতিতেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছেন লালমাটির ‘আদর্শ’ ভূমিসন্তান…

Powered by Froala Editor