২০০ বছর ধরে আতরের গন্ধে মাতোয়ারা চিৎপুর রোড

/১৯

রবীন্দ্র সরণি ও জাকারিয়া স্ট্রিটের সন্ধিক্ষণে খানিকক্ষণ দাঁড়ালেই নাকে ভেসে আসবে চন্দন, গুলাব, অম্বুরী মেশানো একঝলক নবাবী আতরের সুগন্ধ। যে খুসবুর বয়স কম করে হলেও ২০০ বছর।

/১৯

চিৎপুর রোডের এই অঞ্চলে আরেকটু হাঁটলেই দুপাশে সারি সারি দোকান। সেইসব দোকানের র‍্যাকে চমৎকার পলকাটা স্ফটিকের শিশির ভেতর নানা রঙের বা রঙবিহীন তরল। খশ, ফেরদৌসী, জান্নাতুল, শমা, হায়াতি, শাহী, বেলি, অপ্সরা, মৌলসারি—বিচিত্র নাম সুগন্ধের। পরতে পরতে জড়িয়ে নানা কিসসা।

/১৯

ফার্সি শব্দ ‘ইত্তর’ থেকে ‘আতর’-এর উৎপত্তি। যার অর্থ ‘সুগন্ধ।’ বাজারজাত সেন্ট-পারফিউম-এর তুলনায়, যা অনেক বেশি সাচ্চা। এই আতর কীভাবে কলকাতার চিৎপুর রোডে ঠিকানা করে নিল, সেও এক ইতিহাস।

/১৯

কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তা তো বটেই, সম্ভবত বয়সে এই শহরের চেয়েও প্রাচীন চিৎপুর রোড। শোনা যায়, সপ্তদশ শতকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের বড়ো তরফ থাকত হালিশহরে আর ছোট তরফ থাকত বড়িশায়। এই দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াতের জন্যই তৈরি হয় চিৎপুর রোড।

/১৯

“চিৎপুর পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা।/নিশি দিশি বাহে ডিঙ্গা নাহি হেলা।।” – পঞ্চদশ শতকে লেখা বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গলেও উঠে এসেছে চিৎপুরের কথা। সুতানুটির উত্তরে এই গ্রামের নাম তখন সম্ভবত ছিল চিত্তেশ্বরপুর। এই চিৎপুর রোডই পরে হয়ে উঠেছিল কালীঘাটে যাওয়ার প্রধান রাস্তা। সাহেবদের ভাষায় ‘পিলগ্রিম পাথ’। অরণ্যে ঢাকা রাস্তায় ডাকাতের উপদ্রবের কথাও কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে। ডাকাতরাই নাকি পরে তৈরি করেছিল অসংখ্য সোনার দোকান। শহর কলকাতার প্রাচীনতম বাজার ‘নতুন বাজার’-ও গড়ে ওঠে এই রাস্তার ধারেই।

/১৯

১৮৫৬ সালে কলকাতা শহরে পা রাখলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। গড়ে তুলেছিলেন ছোটা লখনৌ। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় আতরের রমরমা। চিৎপুর রোডে ঠাঁইনাড়া বাঁধেন আতরের কারিগরেরা।

/১৯

উনিশ শতকেও এই জনবহুল রাস্তায় থামত জুড়িগাড়ি। বাইজিবাড়ি যাওয়ার আগে আতরপট্টিতে নেমে আসতেন কোনো অভিজাত বাবু। রেশমি রুমাল ম-ম করে উঠত সুগন্ধে।

/১৯

রাস্তা বরাবর হাঁটলে, চোখে পড়বে ‘তাজ মার্কা সুর্মা ঔর কাজল কোম্পানি’-র মতো অসংখ্য আতরের দোকান। কল্পনা করতে ইচ্ছে হয়, বাতাসে ভেসে আসা অপূর্ব সুগন্ধ এমন যানজটের কারণ।

/১৯

প্রায় ১৫৬ বছর ধরে চলে আসছে ‘তাজ মার্কা সুর্মা ঔর কাজল কোম্পানি’-র সওদা। যে ঐতিহ্যবাহী দোকানের পত্তন হয়েছিল এস-মেহর ইলাহী শফির হাত ধরে। ব্যবসার মালিকানা এখন পঞ্চম প্রজন্মের হাতে। এখানে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকায় মেলে সম্পূর্ণ আ্যলকোহল-মুক্ত খাঁটি ভেষজ সুগন্ধি।

১০/১৯

আতর রপ্তানি হয় সারা দেশেও। রমজানের সময় বিক্রি আসমান ছোঁয়। বিহার-ঝাড়খণ্ডে চাহিদা নাকি দেখার মতোই।

১১/১৯

কথিত আছে, খাঁটি আতরের গন্ধের ঝটকায় নাকি যোজন দূরে সরে যায়, ইবলিশ-জিন। জন্নত লাভ হয়, হুর-পরিদের টেনে আনে সুগন্ধ।

১২/১৯

তবে এই আতরপট্টির বেতাজ বাদশা, ‘হাজী খুদা বক্স নবী বক্স’-এর দোকান। ১৮২৪ সালে খাস লখনউ থেকে এসে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন নিয়াজুদ্দিন আল্লাহ বক্সের পূর্বপুরুষরা।

১৩/১৯

ভারত-বাংলাদেশের সর্বত্র চালান যায়, ‘হাজী খুদা বক্স'-এর খাঁটি ফুলেল আতর। দামে একটু চড়া হলেও চিজ সব-সে উমদা।

১৪/১৯

এই দোকানের বাঁধা খদ্দের ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র বসুরা। নেতাজি নাকি এখান থেকে প্রায়শই নিতেন গুলাব ও রজনীগন্ধা। কলকাতা সফরে এলে দোকান ঘুরে যেতেন পন্ডিত নেহরু।

১৫/১৯

শুধুমাত্র সুগন্ধ নয়, ঔষধি হিসেবেও আতরের নামডাক রয়েছে বইকি। যেমন প্রবল গরমে ‘খশ’ ঠান্ডা করে শরীর। আর মাথাব্যথার জন্যে রয়েছে ল্যাভেন্ডার।

১৬/১৯

আতর-বিদ্যা খানিক গুপ্তবিদ্যারই সামিল। এ তো আর পুঁথিপড়া কেমিস্ট্রি নয়। এই বিদ্যা মূলত প্রজন্মবাহিত। আতরের রসায়ন করায়ত্ত করতে দরকার তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি ও সমঝদারের মন। তবে ক্রেতারা ক্রমশ এই মহার্ঘ্য আতর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, আক্ষেপ জানাচ্ছেন দোকানিরা।

১৭/১৯

বিশেষ করে অ্যালকোহলমুক্ত বডি-স্প্রে বাজারে এসে যাওয়ায় আতরের চাহিদা এক ধাক্কায় তলানিতে এসে নেমেছে। তবে বিদেশে এখনও চাহিদা রয়েছে। সে-জন্যই ব্যবসা এখনও টিকে রয়েছে কোনোভাবে।

১৮/১৯

দোকানে থমকে দাঁড়ালে, রীতি-রেওয়াজ মতো রুমালে বা শার্টের হাতায় ঢালা হবে দু-ফোঁটা সুগন্ধি। পরিধানে মিশবে ফুলেল নির্যাস। সমঝদারদের সঙ্গে চলবে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।

১৯/১৯

সব-পেয়েছির বাজারে খাঁটি জিনিস মেলা দুষ্কর। তাই তো অতীতের চাকচিক্য খানিক হারিয়েও আতরপট্টি আজও টিকে আছে কলকাতার বুকে। চিত্রগ্রহণ : হিয়া ভুঁইঞা

Powered by Froala Editor