শহিদ হওয়ার আগেই ইংরেজ জেলাশাসককে হত্যা, রক্তাক্ত মেদিনীপুরের ফুটবল মাঠ

১৯৩৩ সাল। মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ড লোকে লোকারণ্য। ময়দানে উপস্থিত মহামেডান ফুটবল ক্লাব। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে টাউন ক্লাব। হাড্ডাহড্ডি লড়াইয়ের অপেক্ষায় মেদিনীপুরবাসী। খেলা শুরুর ঠিক আগের মুহূর্তে মাঠে উপস্থিত হল একটি গাড়ি, চারিদিকে আঁটোসাঁটো পাহারা। গাড়ি থেকে নামলেন জেলাশাসক বার্জ। ফুটবল খেলা হচ্ছে, আর তিনি থাকবেন না তা হয় নাকি! দর্শকরা অধীর আগ্রহে বসে আছেন। আর তাঁদের মধ্যেই বসে আছেন আরও দুই তরুণ। একজনের বয়স ২২, আরেকজন সদ্য ১৮ পেরিয়েছে। হাতের আড়ালে লুকিয়ে রাখা পিস্তল। আর লক্ষ্য, সামনের ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকা বার্জ…

ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে চলে যাওয়া যাক ১৯১১ সালে। মাত্র তিন বছর আগে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছেন মেদিনীপুরের বীর সন্তান ক্ষুদিরাম বসু। সেই বলিদানের কাহিনি তখনও ফিকে হয়নি। মেদিনীপুরের যুবক, তরুণরা ক্ষুদিরামকে আদর্শ মেনেই বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। একটু একটু করে গর্জে উঠছে এখানকার মাটি। আর এমন পরিস্থিতিতেই সবং থানার সাধারণ একটু গ্রাম জলবিন্দুতে জন্ম নিলেন অনাথবন্ধু পাঁজা। বিপ্লবী শহিদদের ভিড়ে পিছিয়ে পড়া আরও এক বীর তরুণ… 

সুরেন্দ্রনাথ পাঁজা ও কুমুদিনী দেবীর অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা তাঁদের। আর সেই ঘর আলো করে জন্ম নিলেন অনাথবন্ধু। কিন্তু তারপরেই ঘটল বিপদ। তখন ছোট্ট অনাথবন্ধু বয়স বছর তিনেক। মারা গেলেন সংসারের একমাত্র আশ্রয়, খুঁটি— বাবা। আর তো কিছুই রইল না! কুমুদিনী দেবী পড়লেন অথৈ জলে। সঙ্গে অনাথবন্ধু, তখনও বয়স অত্যন্ত কম; এদিকে সংসারের নৌকার হাল ধরার মানুষটিও চলে গেলেন চিরতরে। এখন উপায়? 

দারিদ্র নিজের দাঁড়া আরও শক্ত করল। আর এর মধ্যেই পড়াশোনা শুরু হল অনাথবন্ধুর। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক বিদ্যাটুকু শিখতে শুরু করেছিলেন। এমন সময় পরিবার নিয়ে কুমুদিনী দেবী পাড়ি দিলেন মেদিনীপুর শহরে। যদি সেখানে কোনো আশ্রয় জোটে, ছেলের পড়াশোনা ঠিকঠাক হয়। সেই সূত্রেই মেদিনীপুর টাউন স্কুলে ভর্তি হন অনাথবন্ধু। শুরু হয় পড়াশোনা। এবং এই টাউন স্কুলই তাঁর জীবনকে অন্য খাতে নিয়ে যায়… 

টাউন স্কুলে পড়তে পড়তেই তিনি শোনেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কথা। মেদিনীপুরের এই বিপ্লবী দলটির নাম সমস্ত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল অনাথবন্ধুর মধ্যেও। অবশ্য তখন পরিস্থিতিই ছিল সেরকম। গোটা ভারতেই বিপ্লবের আগুন তীব্র হচ্ছে ক্রমশ। কংগ্রেসের নরমপন্থী নীতির উল্টোদিকে দাঁড়িয়েছিলেন বিপ্লবীরা। যে কোনো মূল্যেই হোক, ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে। স্বাধীন করতে হবে দেশ। উপরন্তু, বাংলায় তখনও বঙ্গভঙ্গের ঘা শোঁকায়নি। আর সেই বিপ্লবের সারণিতেই উঠে এসেছিল মেদিনীপুর। ক্ষুদিরাম একা নন, আরও অনেক তরুণ নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আগুনে। হাতে তুলে নিয়েছিলেন রিভলভার। মেদিনীপুরের মাটি তখন স্বাধীনতার মন্ত্রে ফুটছে টগবগিয়ে… 

প্রথমে জেলাশাসক পেডি, তারপর আবারও আরেক জেলাশাসক ডগলাস। দুজনেই মারা গেলেন বিপ্লবীদের হাতে। মেদিনীপুর তখন ব্রিটিশ পুলিশের ত্রাস। এদিকে নতুন জেলাশাসক কিছুতেই পাচ্ছেন না তাঁরা। প্রত্যেকের মনেই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল মেদিনীপুরের বিপ্লবীরা। সব জায়গায় যেতে রাজি, কিন্তু মেদিনীপুরে নয়। এমন সময় রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হলেন বার্জ। ধুরন্ধর, বুদ্ধিমান এবং সাহসী এই জেলাশাসককে যে এত সহজে কবজা করা যাবে না, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন বিপ্লবীরা। রুটিন বলতে সেরকম কিছুই ছিল না বার্জের। তিনি নিজেই ইচ্ছা করে রাখেননি; যাতে কেউ তাঁর গতিবিধি মেপে নিতে না পারে। এদিকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সও চেষ্টা করছে জেলাশাসক বার্জকে দমন করতে। তাঁর পদক্ষেপ যে বিপ্লবীদের পথে বাধা তৈরি করছে… 

আরও পড়ুন
লাহোর থেকে ছদ্মবেশে কলকাতায়; বিধান সরণির এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

ততদিনে বিপ্লবী দলটির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন অনাথবন্ধু পাঁজা। খুঁজে পেয়েছেন আরেক বন্ধু, মৃগেন্দ্রনাথ দত্তকে। বয়সে চার বছরের ছোটো মৃগেন্দ্রও টাউন স্কুলের ছাত্র, এবং বিপ্লবী। দেশের জন্য সবকিছু করতে রাজি। এদিকে দলের আলাদা খরচও তো আছে। অনাথবন্ধুর পারিবারিক অবস্থা তখনও সেই তিমিরেই; তারই মধ্যে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। খড়গপুরের জমিতে যা ধান চাষ করা হত, তা বিক্রি করেই সংসার চলত কোনক্রমে। একবার এক বছরের ধান বিক্রির অর্থ বাবদ কিছু টাকা হাতে এল অনাথবন্ধুর। কিন্তু এবার মায়ের হাতে নয়; বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের কাছে পুরো টাকাটাই দিয়ে দিলেন তিনি। বাড়িতে ঢুকেছেন খালি হাতে। মা কুমুদিনী দেবী তো অবাক! টাকা কোথায়? অনাথবন্ধুর অকপট জবাব, ‘পকেটমার হয়ে গেছে’। দেশের স্বাধীনতার জন্য এই মিথ্যে বলতে একবারও গলা কাঁপেনি তাঁর? ভারতমাতা যে শেকলে বাঁধা পড়ে আছেন, তাঁকে রক্ষা করতে এটুকু পারবে না মানুষ! অনাথবন্ধুর দৃপ্ত চোখ সেই কথাই বলে যায় বারবার। 

একজন মানুষের কোনো না কোনো দুর্বল জায়গা থাকেই। বার্জেরও ছিল— ফুটবল। এই খেলা দেখলে নিজেকে সামলে রাখতে পারতেন না। আর এই ব্যাপারটাই চোখে পড়ল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের। ব্যস, এখান দিয়েই আঘাত হানতে হবে। কলকাতায় অস্ত্রশিক্ষা দিতে পাঠানো হল অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথকে। ভালো করে শিখে রিভলভার নিয়ে ফিরেও এলেন। এরপর আসল দিন। ১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ডে ফুটবল খেলা দেখতে হাজির হয়েছেন বার্জ। হাজির হয়েছেন অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্তও। মিশে আছেন ভিড়ের মধ্যে। বার্জ গাড়ি থেকে নেমে এগোলেন ময়দানের দিকে। জেলখানা, অস্ত্রাগার মাঠের পাশেই; উপরন্তু সশস্ত্র পাহারা। একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই ছিলেন বার্জ। আর এখানেই সবচেয়ে বড়ো ভুলটা করলেন… 

হঠাৎই দর্শকাসন থেকে শোনা গেল বন্দুকের আওয়াজ। ঘাবড়ে গেল সবাই। অবশ্য ঘাবড়ানোর সুযোগটুকুও পাননি জেলাশাসক বার্জ। ততক্ষণে পরনের পোশাক ভিজে গেছে রক্তে। মোক্ষম নিশানায় বিঁধেছে গুলি। গাড়ির ভেতরেই লুটিয়ে পড়লেন মৃত বার্জ। আর পুলিশরা দেখল, দর্শকাসন থেকে এগিয়ে আসছে দুই তরুণ। হাতে উদ্যত রিভলভার… 

আরও পড়ুন
৬৩ দিন অনশনের পর মৃত্যু বিপ্লবী যতীন দাসের, মরদেহ কাঁধে তুলে নিলেন সুভাষচন্দ্র

আবারও গর্জে উঠল অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রের বন্দুক। আহত হয়ে পড়ে গেলেন এক ইংরেজ ফুটবলার। অন্যদিকে পুলিশও তৈরি হয়ে গেছে। দুই পক্ষেই শুরু হল অসম লড়াই। কিছুক্ষণ পরেই গরম সীসার গোলা এসে বিঁধল দুজনের শরীরে। রক্তে লাল হয়ে উঠল মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ড। আর অনাথবন্ধু? হয়ত শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগে ভাবছিলেন মায়ের কথা, সংসারের কথা, পরাধীন দেশের কথা। নিজেদের কাজ থেকে সরেননি তিনি। বার্জের মৃতদেহের পাশে শুয়েই চোখ বুজলেন অনাথবন্ধু পাঁজা। এইভাবেই স্বাধীনতা আসবে একদিন। ব্রিটিশ ভারত ছাড়বে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ… 

তথ্যসূত্র-  ‘মৃত্যুহীন বিপ্লবী অনাথবন্ধু ও মৃগেন্দ্রনাথ’, এখন খবর    

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
মুসলিম লিগের সঙ্গী সুভাষচন্দ্র - বলেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সাক্ষী কিশোর মৃণাল

More From Author See More