একের পর এক বই হাতে লিখে পুঁথির স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে ফরিদপুরের কিশোর

“আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে ছিল একটা ফলের দোকান। ছোটোবেলায় একবার সেখানে গিয়ে কিছু বিদেশি পত্রিকার পাতা দেখেছিলাম। দোকানদার বলেছিল, এগুলো ভারতীয় পত্রিকা। ভারত থেকে ফলের সঙ্গে আসে।” সেই পত্রিকা বাড়িতে নিয়ে এসে অজানা ভাষার অচেনা অক্ষর নকল করতে শুরু করে ফরিদপুরের ফ্রাহিম মুহম্মদ সাদ। তখনও সে স্কুলের চৌকাঠ পেরোয়নি।

অবশ্য এর আগেই কোয়ার্টারের মসজিদে আসা তাবলীগ জামাতদের সূত্রে বিদেশি অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার। অক্ষরের প্রতি ভালোবাসা তখন থেকেই। তারপর প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় চিনা ভাষার বই কেনা। ফ্রাহিম বলছিল, “সেই বই কিনেছিলাম বাবা পকেট থেকে ত্রিশ টাকা চুরি করে।” অক্ষর চেনা আর সেই অক্ষর হাতের লেখায় ফুটিয়ে তোলাই হয়ে উঠল ফ্রাহিমের নেশা।


এখন ফরিদপুরে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ফ্রাহিম। তবে পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনোকিছু তাকে টানেনি কোনোদিন। সারাদিন কেটে যায় নিজের ঘরে টেবিল চেয়ারে বসে নানারকম ছাপার অক্ষর নকল করার কাজে। এখন অবশ্য না দেখেই বহু ভাষার লিপি লিখতে পারে সে। বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, উর্দু, চিনা ভাষা তো আছেই। তার হাতে লেখা লিপির উপর তৈরি হতে চলেছে হিব্রু ভাষার ইউনিকোড ফন্টও।

আরও পড়ুন
কাশ্মিরি শালের আদলে নকশিকাঁথা, নেপথ্যে বাঙালি শিক্ষক

ফ্রাহিমের বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার কথায়, “বাবার হাতের লেখা খুব সুন্দর। তাই বাবার মতো আমিও সুন্দর হাতের লেখার চেষ্টা করতাম।” অবশ্য এসবের জন্য প্রশংসা যেমন সে পেয়েছে, তেমনই নানা জটিলতাও তৈরি হয়েছে। স্কুলে শিক্ষকরা তার হাতের লেখা অ্যাসাইনমেন্টকে মনে করেছে ডিজিট্যাল প্রিন্টের কাগজ। ফলে সেই অ্যাসাইনমেন্ট বাতিল হয়েছে। “মায়ের কাছেও মাঝে মাঝে মার খেয়েছি।” হাসতে হাসতে জানাল সে।

আরও পড়ুন
ফুটবল ক্লাবের নাম ‘বেঙ্গল’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাজত্ব বাঙালিদের?

আরও পড়ুন
প্রাথমিক পর্যায়েই চিহ্নিত করা যাবে সিলিকোসিস, পথ দেখালেন বাঙালি গবেষক

মায়ের হাতের মার খাওয়ার কারণ অবশ্য হাতের লেখা নয়। প্রাচীনকালে এইসব লিপি লেখার কাজ কীভাবে হত, তা নিজে হাতেকলমে দেখতে চেয়েছিল ফ্রাহিম। প্রাচীন ভারতের পুঁথি লেখার পদ্ধতি বুঝতে পাখির পালকে লিখে দেখেছে সে। অবশ্য রাজহাঁসের পালক সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। তাই মুরগি এবং পায়রায় পালক দিয়েই লিখেছে সে। এছাড়া মিশরীয়দের পাথর খোদাই করে লেখার পদ্ধতি আয়ত্ত করতে রেললাইন থেকে পাথর কুড়িয়ে এনেছে। তবে সেই পাথর ঘষেও তাকে লেখার উপযোগী করে তোলা যায়নি।

ফ্রাহিমের হাতের লেখা পুঁথি এখন পাড়ি দেয় বিদেশেও। সম্প্রতি পোল্যান্ডের একটি গির্জার অনুরোধে আরমাইকে লিপিতে খ্রিস্টধর্মের নানা উপদেশ লিপিবদ্ধ করছে সে। আবার কখনও বিভিন্ন জনপ্রিয় বই অনুলিপির কাজও করে সে। কখনও নিজের শখে, আবার কখনও কারোর অনুরোধে। বিভিন্ন লেখার সঙ্গে ছবিও আঁকে নিজেই। কখনও কোনো অলঙ্করণ থেকে অনুকরণের চেষ্টা করে। কখনও আবার নিজের কল্পনার রস মিশিয়ে ছবি তৈরি করে।

লিপির প্রতি ফ্রাহিমের এই ভালোবাসার সূত্রেই যোগাযোগ ঘটেছে আন্দামান নিবাসী ভিজে বিশ্বের সঙ্গে। দুজনে মিলে চলছে সিন্ধু সভ্যতার লিপি উদ্ধারের চেষ্টা। অবশ্য কোভিড অতিমারীর কারণে সেই কাজ এখন বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি আবারও গবেষণা শুরু করতে চায় ফ্রাহিম। আর অবশ্যই পুঁথি লেখার প্রাচীন অভ্যাসকেও ফিরিয়ে আনতে চায় নতুন করে। তার কথায়, “প্রাচীনকালে যখন সমস্ত পুঁথি হাতে লেখা হত, তখন তা অনেক সুন্দরও হত।” ফ্রাহিমের হাতের রেখায় সেই সৌন্দর্যটুকুই বেঁচে থাকুক।

Powered by Froala Editor

More From Author See More