কাশ্মিরি শালের আদলে নকশিকাঁথা, নেপথ্যে বাঙালি শিক্ষক

“কাশ্মিরি শাল যেমন কাশ্মিরের ঐতিহ্য, তেমনই কাঁথা শিল্পের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে বাংলার দীর্ঘ ইতিহাস। সেখান থেকেই মাথায় আসে যদি বাংলা এবং কাশ্মিরের দুই সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটানো যায়।”

বলছিলেন পিনাকী গুহ। বাংলা ও কাশ্মির— এই দুই রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সংমিশ্রণের নেপথ্যে রয়েছেন ২৪ পরগণা জেলার আমতলার পীরতলা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই শিক্ষকই। হ্যাঁ, এবার তাঁর তত্ত্বাবধানেই কাশ্মিরি শালের বুননে নতুন রূপ পেয়েছে বাংলার কাঁথা। কাঁথা শিল্পের ক্ষেত্রে এই দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন সম্ভবত এই প্রথম। কিন্তু হঠাৎ ব্যতিক্রমী এমন একটি ফিউশনের চিন্তাভাবনা কেন? 

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ খানিকটা সময়। বছর দেড়েক আগের কথা। ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বাংলার কাঁথা শিল্পকে নিয়ে গবেষণা এবং পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন পিনাকী গুহ। রেডিমেড ব্ল্যাঙ্কেটের যুগে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যেতে বসা কাঁথা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি। ডায়মন্ডহারবারের শিল্পীদের দিয়েই তিনি তৈরি করান হারিয়ে যেতে বসা একাধিক নকশা ও বুননের কাঁথা। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে, নতুন ধরনের বুননের অনুসন্ধান শুরু করেন পিনাকীবাবু। 

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাচ্ছে ‘কলাই শিল্প’, জীবন-জীবিকার লড়াই চালাচ্ছেন সুরেখা

সেই অনুসন্ধানই নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিল শীতের ঠিক প্রাক্বালে। কলকাতা তো বটে, প্রতিবছর এই সময়টায় বাংলায় ভিড় করেন বহু কাশ্মিরি শালওয়ালা। দুই রাজ্যের এই সংস্কৃতিক সম্পর্ক শতাব্দীপ্রাচীন। রাজা রামমোহন রায়ের আমল থেকেই কাশ্মিরের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাংলার। কিন্তু মহামারীর আবহে কোপ বসেছিল কাশ্মিরের শালওয়ালাদের সেই ব্যবসার প্রসারে। কলকাতায় বিক্রির পরিমাণও নেমে এসেছিল তলানিতে। সেখান থেকেই বাংলার এই পরিযায়ী বন্ধুদের পাশে দাঁড়ানোর চিন্তাভাবনা করেন আমতলার শিক্ষক।

আরও পড়ুন
রোবটিক্সের মাধ্যমে পুতুল নাচ, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোগ ইঞ্জিনিয়ারের

আরও পড়ুন
পক্ষাঘাতে হারিয়েছে চলচ্ছক্তি, মুখ দিয়েই ছবি আঁকেন বাংলাদেশের শিল্পী

“কাশ্মিরের শালে মূলত জামেবারের কাজ হয়। অথচ বাংলায় একেবারেই ব্রাত্য এই শিল্প। সেখান থেকেই এই বুনন পদ্ধতিতে কাঁথা বোনার পরিকল্পনা মাথায় আসে”, জানালেন পিনাকী গুহ। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। কাশ্মিরের জামেবার শিল্পী ও শাল বিক্রেতা ইউনুসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন পিনাকীবাবু। ভিডিওকলের মাধ্যমেই তাঁকে কাঁথা বোনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন পিনাকীবাবু। তবে তাঁর পরিকল্পনাকে এত নিপুণভাবে বাস্তবায়িত করবেন ইউনুস, তা নিজেও ভাবেননি তিনি। পিনাকী গুহের কথায়, “অবাক করার বিষয় হল মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই গোটা কাজটা বুঝে নিয়েছিল ইউনুস। তারপর মাত্র ২ দিনের মধ্যে ও দুটি জামেবারের কাঁথা বুনে দেয়।”


হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। মাত্র দু’দিনের মধ্যেই দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটান কাশ্মিরি শিল্পী ইউনুস। দিন পনেরোর মধ্যেই কলকাতায় সেই কাঁথা নিয়ে হাজিরও হয়েছেন তিনি। এখন শুধু ক্রেতার জন্য অপেক্ষা। শুধু অভিনব শীতবস্ত্র হিসাবেই নয়, জামেবারের এই কাঁথা যেন স্বয়ং একটি অধ্যায় হয়ে থাকল বাংলার শিল্প-ইতিহাসের। এই কাঁথার দৌলতেই আগামীতে লাভের মুখ দেখবেন কাশ্মিরের পরিযায়ী শালশিল্পীরা, সে ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী ইউনুস এবং পিনাকী দু’জনেই…

Powered by Froala Editor