হারিয়ে যাচ্ছে ‘কলাই শিল্প’, জীবন-জীবিকার লড়াই চালাচ্ছেন সুরেখা

ফুটপাথের ধারে জ্বলছে কয়লার ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড। আর তার ওপর বসানো একটি কাঁসারের পাত্র। আগুনের আঁচে গরম করার পর পাশে রাখা পাথরের গামলায় ঠান্ডা জলে বেশ খানিকক্ষণ চুবিয়ে রাখা হচ্ছে পাত্রটিকে। তারপর আবার তা উত্তপ্ত করা হচ্ছে চুল্লিতে। মহারাষ্ট্রের থানে স্টেশনের ঠিক বাইরে অবস্থিত গাঁওদেবী লেনে গেলেই চোখে পড়বে এই দৃশ্য। স্থানীয়দের কাছে যা পরিচিত ‘কলাই শিল্প’ নামে। পুরনো কাঁসার ও পিতলের বাসনপত্রকে ঘষে-মেজে নতুন করে তোলাই কাজ কলাইওয়ালাদের (Kalaiwala)।

এক দশক আগেও, গাঁওদেবী লেনে দেখা মিলত অন্ততপক্ষে খান দশেক কলাইওয়ালার। এখন সেই সংখ্যাটা এসে ঠেকেছে কেবলমাত্র এক জনে। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের ধারাকে বহন করে চলেছেন ৩৮ বছর বয়সী কলাইশিল্পী সুরেখা রমেশ ক্ষীরসাগর (Surekha Ramesh Kshirsagar)। অসম লড়াই করে চলেছেন বহু প্রতিবন্ধকতা এবং বর্তমান আর্থ-সামাজিক টালবাহানার সঙ্গে। 

বিগত এক দশকে কলাই শিল্পের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে দ্রুত গতিতে। একটা সময় কাঁসার ও পিতলের তৈরি পাত্রই ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। এখন সেই জায়গাটা দখল করেছে ফাইবার আর কাচের তৈরি পাত্র। হয়ে উঠেছে আধুনিকতার চিহ্ন। আর সেই কারণেই কাঁসার ও পিতলের তৈরি বাসনের ব্যবহার উঠে যেতে বসেছে দেশজুড়ে। মহারাষ্ট্রেও অন্যথা হয়নি তার। সামাজিক রীতির এই বদলই চরম আর্থিক অনটনের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে কলাইশিল্পীদের। গ্রাহকদের সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে বর্তমানে। 

এই মন্দার বাজারে কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল কোভিড মহামারী। যে গুটিকয়েক কলাইশিল্পী অবশিষ্ট রয়েছেন মহারাষ্ট্রে, তাঁরাও কাজ হারিয়েছিলেন ২০২০ সালের মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর। তাছাড়াও বন্যা, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই ছিল গোটা বছরজুড়ে। কোনো স্থায়ী দোকানঘর না থাকায়, এসব প্রতিবন্ধকতা যেন আরও বিপন্ন করে তুলেছে ঐতিহ্যবাহী শিল্পীদের। 

আরও পড়ুন
রোবটিক্সের মাধ্যমে পুতুল নাচ, ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোগ ইঞ্জিনিয়ারের

প্রথম ওয়েভেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুরেখা রমেশ। মারণ ভাইরাস কেড়ে নিয়েছিল তাঁর স্বামীর প্রাণও। বছর খানেক এই ব্যবসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকলেও দ্বিতীয় তরঙ্গের পর পুনরায় বাধ্য হয়ে ফুটপাথে ফিরেছেন সুরেখা। এটাই যে জীবিকার একমাত্র পথ। নাহলে সংসার চলবে কীভাবে? কোভিড বিধি শিথিল হওয়ায় উপার্জনের পথ যে খুব প্রশস্ত হয়েছে, তেমনটা নয়। তিনজনের সংসারে দু’বেলার অন্নসংস্থানের ব্যবস্থাটুকু হচ্ছে কোনোমতে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? সরকারও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি কোনোভাবে। অসম লড়াইয়ের একদিন না একদিন হার মানতে হবে, তাও জানেন সুরেখা। স্থানান্তরিত হতে হবে অন্য কোনো জীবিকায়। তবুও ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে, পরিবারিক ধারাকে জীবিত রাখার চেষ্টা করে চলেছেন তিনি…

আরও পড়ুন
পক্ষাঘাতে হারিয়েছে চলচ্ছক্তি, মুখ দিয়েই ছবি আঁকেন বাংলাদেশের শিল্পী

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কলমকারি শিল্পকে বাঁচাতে স্কুল পড়ুয়াদের উদ্যোগ