ফেক নিউজ ও ডিজিটাল ভারত : সারাবছরই ‘পয়লা এপ্রিল’ যে-দেশে

শুনেছেন কি, গোপন যুদ্ধবিমানে করে ভারতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে শত্রু দেশগুলো! আরে দাঁড়ান মশাই, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। একবার ক্যালেন্ডারে তারিখটা দেখুন না। হ্যাঁ, আজকের দিনে একটু রঙ্গ-রসিকতা তো চলতেই পারে। তবে বিষয়টা যখন আর একদিনে থেমে থাকে না, তখন সত্যিই দুশ্চিন্তার কারণ থেকে যায়। অন্তত ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভুয়ো সংবাদ পরিবেশন রীতিমতো আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মধ্যে তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও তাই নিয়ে আলোচনা নেহাৎ কম হচ্ছে না।

২০২০ সালে ভারতে ভুয়ো সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। আর এর একটা বড়ো অংশ জুড়েই রয়েছে করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত খবর। সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে সেসব। কেউ জানাচ্ছেন, থালা বাজানোর শব্দে করোনা পালাবে। কেউ আবার বলছেন প্রদীপ জ্বালালে তার তাপে ভাইরাস মরে যাবে। তবে এসব নেহাৎ নিরীহ গুজব। মানুষের মনে মিথ্যা আত্মবিশ্বাস ছাড়া কিছুই দেয় না। তবে মাঝে মাঝে এক একটা গুজবই হয়ে ওঠে নৃশংস। ঠিক যেমন মহারাষ্ট্রে শোনা গিয়েছিল মুসলমান যুবকদের নাকি বাছাই করে তাঁদের শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গুজবের অনিবার্য ফলশ্রুতি ধর্মীয় হিংসা এবং দাঙ্গাপরিস্থিতি।

২০১৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশের ৮৮ শতাংশ তরুণ ভোটদাতা ভুয়ো খবর সম্বন্ধে চিন্তিত। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় এই ধরণের খবর আরও অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে বলেই মনে করছেন তাঁরা। এখনও পশ্চিমবঙ্গ সহ তিনটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। প্রতিটা দিনই এপ্রিল ফুল। আন্তর্জাতিক সমীক্ষার রিপোর্টেও দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক ঘটনাকে ঘিরেই ভুয়ো সংবাদের পরিবেশন বেশি হয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসমস্ত খবরের শিকার সংখ্যালঘু, দলিত বা ভিন্ন যৌনতার মানুষরা। রয়টার্স পত্রিকার গত ডিসেম্বর মাসের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে গত ৩ বছরে ভুয়ো সংবাদের সংখ্যা বেড়েছে ৫ শতাংশ।

আসলে ভারতের মতো জটিল সামাজিক ব্যবস্থায় ভুয়ো সংবাদ আটকানোর প্রক্রিয়াটিও বেশ জটিল, এমনটাই মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের আধিকারিকরা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কখনোই এইসব খবর শনাক্ত করা সম্ভব নয়। আর এই জটিলতার জায়গাটিই খুব সহজে ব্যবহার করছেন একদল মানুষ। সঙ্গে অবশ্যই সাহায্য করছে ইন্টারনেট পরিষেবার অতি দ্রুত বিকাশ। রয়েটার্স পত্রিকার বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি কিছুই। ফলে অতি সহজেই মানুষকে বোকা বানানো সম্ভব।

আরও পড়ুন
এই প্রথম সংবাদ-উপস্থাপকের ভূমিকায় কোনো রূপান্তরকামী, অনন্য নজির বাংলাদেশে

রয়টার্স পত্রিকা একইসঙ্গে অভিযোগ তুলেছে সামাজিক মাধ্যম সংস্থাগুলির কর্ণধারদের ভূমিকা নিয়েও। সেখান থেকেই জানা যায়, গত বছর ফেসবুক ইন্ডিয়ার বার্ষিক নীতিনির্ধারণ সভায় ঠিক হয় কেন্দ্র বা রাজ্যের কোনো শাসক দলের পোস্টকে কোনোভাবেই সেন্সরশিপের আওতায় আনা হবে না। আর এর পরেই এক ধাক্কায় ভুয়ো সংবাদের সংখ্যা বেড়ে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। স্পষ্টতই সেখানে শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদত দেখা যায়। তবে আজকের দিনে একটু রঙ্গরসিকতা চলতেই পারে। শুধু বছরের বাকি ৩৬৪ দিন সচেতন থাকতেই হবে। ইন্টারনেট যেমন মানুষকে কাছাকাছি এনেছে, তেমনই তাকে ব্যবহার করছেন একদল অশুভ মানসিকতার মানুষ। সামাজিক সচেতনতাই পারে তাদের রুখে দিতে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
গৃহহীন মানুষদের নিজস্ব সংবাদপত্র, উপার্জনের স্বপ্ন ও একটি বিপ্লবের গল্প

More From Author See More