গৃহহীন মানুষদের নিজস্ব সংবাদপত্র, উপার্জনের স্বপ্ন ও একটি বিপ্লবের গল্প

আমেরিকা মানেই আমাদের কাছে বৈভবের চূড়ান্ত উদযাপন। টাইমস স্কোয়ারের আলো ঝলমলে পৃথিবী হোক, বা লাস ভেগাসের নৈশ হাতছানি— আমেরিকা আমাদের অনেকের কাছেই স্বপ্নের দেশ। যেন সেখানে কারোর মনে দুঃখ নেই; কেবল আছে ডলারের ঝনঝনানি। সত্যিই কি তাই? রাস্তায় বেরোলে যে ভবঘুরে, ভিক্ষুক মানুষদের দেখি, ফুটপাতে শুয়ে থাকা গরীবদের দেখি— আমেরিকায় কি সেসব একদমই নেই? যদি এটাই আপনার ধারণা হয়, তাহলে সেটা ভুল!

আমেরিকার রাস্তাও সাক্ষী থাকে এমন উদ্বাস্তু জীবনের। মাথার ওপর ছাদ নেই, পকেটে টাকাও নেই তেমন, খাওয়াও হয়তো জোটেনি— আর তাই নিয়েই ঝাঁ-চকচকে রাস্তার পাশে বসে থাকেন তাঁরা। আমেরিকার গৃহহীন, অসহায় মানুষ। আশির দশকের শেষে তাঁরাই ছড়িয়ে পড়েছিলেন আমেরিকায়। তৈরি হয়েছিল ছোটখাটো একটি বিপ্লব। কিন্তু কী নিয়ে? কিছু না, সামান্য একটি খবরের কাগজ। যা ছিল কেবলমাত্র রাস্তায় বসবাস করা মানুষদেরই। আর সেটাই হয়ে উঠেছিল স্বনির্ভরতার হাতিয়ার। 

সালটা ১৯৮৯। হাচিনসন পারসনস ছিলেন আমেরিকারই এক স্ট্রিট সিঙ্গার। মানে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়াতেন তিনি। যথেষ্ট পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন একটা সময়। তিনি ঠিক করলেন, আমেরিকার এই ঘরহীন, রাস্তায় দিন কাটানো মানুষগুলোর জন্য একটি বিশেষ কনসার্ট আয়োজন করবেন। এখান থেকে যা পাবেন, তার সবটাই এই অসহায় মানুষগুলোর হাতে তুলে দেবেন। প্রশংসনীয় একটা ভাবনা। কিন্তু এই ভাবনা সেভাবে সফল হল না। টাকা উঠলেও, তা দিয়ে সবার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাহলে? 

এবার একটা পোস্টার তৈরি করে হাচিনসন আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগলেন। সাধারণ নাগরিক থেকে কর্পোরেট— সবার কাছে তুলে ধরলেন ওই মানুষদের প্রকৃত অবস্থা। শুধু আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্বেও তো একই পরিস্থিতি। যদি কিছু সাহায্য করা যায়। তখনই অন্য একটি ভাবনা মাথায় খেলে গেল। আচ্ছা এরকমভাবে কতজনের কাছ থেকে চাওয়া যাবে? তার থেকে কেমন হয়, যদি ওই পথে জীবন কাটানো মানুষগুলো নিজের পায়ে দাঁড়ায়? নিজেরাই রোজগারের রাস্তা করে নেয়? 

এবং এই ভাবনা থেকেই শুরু হল নতুন একটি জিনিসের। তৈরি হল ‘স্ট্রিট নিউজ’ নামের সংবাদপত্র। সকাল সকাল কাঁধে কাগজের বান্ডিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত ওই মানুষগুলো। রাস্তায়, মেট্রো স্টেশনে, বাজারে— সমস্ত জায়গায় এই একটাই বার্তা। আমেরিকার রাস্তায় কাটানো মানুষগুলোর জন্য তৈরি হয়েছে এই খবরের কাগজটি, যদি কেউ কেনেন। অভিনব একটি ভাবনা। স্ট্রিট নিউজকে দেখে আরও বেশ কিছু সংবাদপত্র শুরু হল। সবার লক্ষ্য একটাই— পথে দিন কাটানো মানুষগুলো যদি একটু রোজগার করতে পারে… 

প্রথমেই অভূতপূর্ব সাড়া পেল ‘স্ট্রিট নিউজ’। একেক ইস্যুর প্রায় আড়াই লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হতে শুরু করল। হাচিনসন পারসনস রীতিমতো খুশি। তাহলে এই মানুষগুলোর কাছে একটু হলেও তো টাকা পৌঁছচ্ছে! এটা তো তাঁদের হকের রোজগার। আর এই সময়ই তাঁর কাছে এলেন লি স্ট্রিঙ্গার নামে এক আমেরিকান। ইনিও গৃহহীন, একটা সময় ড্রাগ সেবনও করেছেন। তাঁর নিজের জীবনকাহিনিও অন্যরকম। তিনি চান, ‘স্ট্রিট নিউজ’-এর পাতায় যাতে ছাপা হয় তাঁর লেখা। সেটাই শুরু। লি স্ট্রিঙ্গার নিজেও হয়তো ভাবেননি এমন ঝরঝরে লেখা তাঁর কলম থেকে বেরোবে। একেবারে রাস্তার মানুষ তিনি; আর আজ আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত ও পরিচিত লেখক। 

আরও পড়ুন
বাংলার প্রথম বাণিজ্যিক গোলাপ, বাঁকুড়ার ফুলেই ভালোবাসার উদযাপন কলকাতায়

একটা সময় লি-ও স্ট্রিট নিউজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। সবারই একটাই স্বপ্ন, অসহায় মানুষগুলো যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। নব্বইয়ের দশকের মাঝখানে এসে এই সংবাদপত্রটির বিক্রি কমে যায়। কিন্তু ততদিনে ‘স্ট্রিট নিউজ’-কে দেখে আরও কিছু কাগজ বাজারে এসেছে। মানুষের হাতে টাকা আসছে। চ্যারিটির টাকা নয়; নিজের পরিশ্রমে উপার্জন করা টাকা। তৈরি হল একটি বিপ্লব। এমন বিপ্লব তো চুপিসারেই ঘটে...

Powered by Froala Editor