গ্রেপ্তার রিয়া চক্রবর্তী; টিআরপি-র লড়াইয়ে পিছনের সারিতে অর্থনীতি থেকে বেকারত্ব

গত এক দশক ধরেই ভারতীয় টেলিভিশনের যে হালহকিকত, তাকে ভীষণভাবেই নিম্নগামী বললেও অত্যুক্তি হয় না বলেই মনে হয়। এর মূল কারণি হল সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত হয়ে ‘রেটিং’ নামক খুড়োর কলের পিছনে অন্ধের মতো ছুটে চলা। খবর এবং বিতর্ক সভার নামে একই মুখগুলোর যে কোনও বিষয় নিয়েই চর্বিতচর্বণ, ভারসাম্যহীন প্রতিবেদন, সংবেদনশীল সংবাদের নামে যে কোনও বিষয়কে ‘সনসনি’ করে তোলার চেষ্টা ক্রমাগত টেলিভিশন নিউজ মিডিয়াকে একটা ভাঙা ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত করেছে।

তবে, বলিউড তারকা সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার পর থেকেই যেন আরও চোখে লাগছে টিভি মিডিয়ার এই নিম্নগামিতা। সুশান্তের মৃত্যুর পর থেকেই বিভিন্ন মিডিয়া আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করেই প্রায় প্রতিদিনই সালিশি সভা বসাচ্ছে তাদের স্টুডিওতে। কখনও কখনও স্টুডিওর আলোচনা এতটাই নিম্ন স্তরে নেমে আসছে যে, প্রায় মধ্যযুগীয় কথোপকথন শুনতে হচ্ছে দর্শকদের। সুশান্তের মৃত্যুর পিছনে কারণ হিসেবে এমনকি ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ অথবা ‘কালা জাদু’র কথাও উঠে এসেছে সর্বভারতীয় মিডিয়ায়। সেই সঙ্গেই তাল মিলিয়ে মিডিয়া যেন অনুঘটকের কাজ করেছে আঞ্চলিক বিদ্বেষ তৈরি করতেও। অকালে চলে যাওয়া বলিউড হিরোর ট্র্যাজিক পরিণতি বর্তমানে মিডিয়ার রেটিং বাড়ানোর এবং অপর দিকে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে লড়াই করার তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই মৃত্যুর পর থেকেই সমস্ত ঘটনাকে ছাপিয়ে উঠে আসছে রিয়া চক্রবর্তীর নাম। মাদক চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁর ভাইকে। রিয়াকেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। এর মধ্যেই মিডিয়ার হাতে আজ উঠে এল আরেকটি টাটকা খবর। গ্রেপ্তার হলেন রিয়া চক্রবর্তী।

বস্তুতপক্ষে, যে কোনও অপরাধের প্রকৃত তদন্ত ছাড়া অপরাধীর দিকে আঙ্গুল তোলাও যে আসলে আইনেরই অবমাননা, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ যেন ভুলতে বসেছে সেই সহজ সত্যটাই। একাধারে তদন্তকারীর ভূমিকা থেকে শুরু করে বিচারকের রায়দানের ভূমিকা অবধি সব চরিত্রেই দেখা যাচ্ছে মিডিয়ার অবাধ নির্লজ্জ বিচরণ। ফলে দেশের গণতন্ত্রের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ারটি আজ পরিণত হয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন একটি বোবা যন্ত্রে। বেশিরভাগ সময়ই টিভি চ্যানেলগুলি যেন কথা বলছে অন্য কারুর হয়ে। অথচ নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদর্শন বরাবরই সংবাদমাধ্যমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে একদম প্রাথমিক লগ্নে বিঘ্নিত হচ্ছে সেই মূল শর্তটিই।

সুতরাং, সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে যে, কেন এই বিশেষ তৎপরতা সুশান্ত সিং রাজপুত মামলার গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াটিকে ঘিরে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে দেশের অর্থনীতি যে প্রবল ভাবে বিধ্বস্ত, সে কথা আজ আর নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তাই এই সরকারি এবং রাজনৈতিক গাফিলতি থেকে জনসাধারণের চোখ ঘুরিয়ে রাখতেই কি এই নতুন খেলার অবতারণা? প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেওয়াও কিন্তু যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন
মহামারীর প্রভাবে বদলাচ্ছে সাংবাদিকতার পেশাও, প্রশস্ত হচ্ছে ওয়েব মিডিয়ার পথ

তথ্য বলছে, গত ৪৫ বছরের মধ্যে দেশের বেকারত্ব পৌঁছেছে চরম সীমায়। শুধুমাত্র করোনা সময়কালে ১২ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়েছেন সারাদেশে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ছবি নিশ্চই কেউ ভুলে যাইনি আমরা এখনও। যদিও বরাবরই সরকার দাবি করে এসেছিল যথেষ্ট ভালভাবেই সারাদেশে মোকাবিলা করা হয়েছে এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, কিন্তু বাস্তব ছবিটা উল্টো কথাই বলছে।

লকডাউন পর্ব পেরিয়ে ধীরে ধীরে আনলক পর্বের দিকে গোটা দেশকে এগিয়ে যেতে প্রধানমন্ত্রী আবেদন জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই। স্বাভাবিকতার পথে হাঁটতে গিয়েও কিন্তু হোঁচট তবু লাগছেই। মোট আক্রান্তের সংখ্যায় ইতিমধ্যেই ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভারত। সামনে এখন শুধুই আমেরিকা। এই অগ্রগমন খুব একটা গর্বের নয় অবশ্যই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক ধাক্কা এসেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। একদিকে জোর করে বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের একগুঁয়েমি, অন্যদিকে দীর্ঘদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় তীব্র প্রতিবাদে সামিল হয়েছে দেশের ছাত্রমহল।

আরও পড়ুন
দেশের মূল সমস্যা এড়িয়ে যাচ্ছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলি : পি সাইনাথ

সরকারের কথা অনুযায়ী এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’ বলে খানিকটা হলেও দায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা হয়েছিল বটে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা বরাবরই সাবধান করে আসছিলেন দেশের আর্থিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে। ভুললে চলবে না, সেটা কিন্তু ভাইরাসের আক্রমণের আগে থেকেই। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্যি করে ভারতের জিডিপি নেমে এসেছে বিগত চার দশকের মধ্যে সবার নিচে। তার সঙ্গেই জিএসটি আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্র। রাজ্য সরকারগুলি নিজের নিজের ভাগের জিএসটির পরিমাণ না পাওয়ায় শামিল হয়েছে প্রতিবাদে। স্বাভাবিকভাবেই থমকে গেছে উন্নয়ন। তার সঙ্গেই দেশের সীমান্তে চিনের সৈন্যদের অনুপ্রবেশ উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিও সামাল দিতে বিশেষ সফল হয়েছে বিদেশ দফতর, সে কথা কিন্তু বলা যায় না।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, এইসব বিষয় চারপাশে ঘটে চললেও প্রাইম টাইমে কিংবা মূল ফোকাসে সবসময়ই থেকে গিয়েছেন রিয়া চক্রবর্তী। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর তদন্তে ঠিক কতটা দায়ী তার বান্ধবী, সেই ঘটনাকেই যেন দেশের পক্ষে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে তুলে ধরা হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। এর পিছনে শুধুই কি মিডিয়ার রেটিং পাওয়ার জন্য দৌড়, নাকি রয়েছে অন্য যোগসাজশও?

আরও পড়ুন
মিডিয়ার তৈরি গুজব, বাঘ সন্দেহে নাকি 'হত্যা' বাঘরোলকে

যেভাবে আসন্ন বিহার নির্বাচনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু করে তোলা হচ্ছে মৃত বলিউড অভিনেতাকে, তাতে খটকা একটা লাগে বৈকি। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে বিভিন্ন টিভি মিডিয়াকে কম পরিশ্রম করতে দেখা যায়নি। তাই এক্ষেত্রে যদি সত্যি হয়ে থাকে সেই ঘটনাই, তবে গণতন্ত্রের কাছে তা একটা বড়সড় আঘাতই বটে। সঠিক এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিরপেক্ষভাবে দেশের জনগণের সামনে তুলে ধরাই সংবাদমাধ্যমের এক এবং একমাত্র প্রধান কাজ। এই একদম প্রাথমিক লগ্নের প্রতিশ্রুতির কাছে যত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলি, ততই তাড়াতাড়ি কিন্তু শক্ত মেরুদণ্ডের উপর ভর করে দাঁড়াবে দেশের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিটিও। তার আশু প্রয়োজন এখনই।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

More From Author See More