তেল উত্তোলনের আড়ালে অরণ্যধ্বংসই নিয়তি? অপেক্ষায় ইকুয়েডরবাসী

আমাজন বৃষ্টিচ্ছায় অরণ্যভূমির অন্তর্গত ইকুয়েডরের ইয়াসুনি ন্যাশনাল পার্ক। প্রায় এক লক্ষ হেক্টর জুড়ে নিবিড় জঙ্গল। তার নিচেই আছে তেলের খনি। আপাতত দেশবাসীর হাতে ইয়াসুনির ভবিষ্যৎ। আগামী রবিবারের ভোটে ইকুয়েডরের জনগণ বেছে নেবে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে তাঁরা রক্ষা করতে চায় কিনা!

জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট ক্রমাগত চোখ রাঙিয়ে চলছে সমগ্র বিশ্বকে। একদিকে লাগাতার বিশ্ব উষ্ণায়ন, অন্যদিকে ক্রমাগত অরণ্যভূমি উচ্ছেদে বিপন্ন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। রেহাই নেই দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অববাহিকার সর্ববৃহৎ ক্রান্তীয় অরণ্যেরও। জীববৈচিত্র্যে পূর্ণ বহু আদিম অরণ্যজীবী মানুষের বাসস্থানকে নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে শিল্পায়ন, তৈল উত্তোলনের প্রক্রিয়া।

একই ঘটনা ঘটেছে ইকুয়েডরের ইয়াসুনি অরণ্যভূমির সঙ্গে। এই অঞ্চলের নিচে রয়েছে অন্তত ষোলোটি তেলের ব্লক। ১৯৮৯ সালে ‘ইউনেস্কো’র পক্ষ থেকে ইয়াসুনিকে বিশেষ সংরক্ষিত অঞ্চল বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কোরেয়া বিশ্বের তাবড় দেশগুলির কাছে এই অরণ্যভূমিকে রক্ষার সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হন। তারপরই সরকার পার্ক এলাকা থেকে খনিজ তেল উত্তোলনের সিদ্ধান্তে শিলমোহর দেয়। 

২০১৬ থেকে আইটিটি নামক একটি কোম্পানি তৈল উত্তোলনের কাজ শুরু করে। প্রত্যেকদিন প্রায় উত্তোলিত হয় ৫৭০০০ ব্যারেল তেল, যা ইকুয়েডরের মোট খনিজ তেল উৎপাদনের ১২ শতাংশ। কর্তৃপক্ষের যুক্তি ছিল এই তেল ভূগর্ভস্থ থেকে গেলে প্রতি বছর প্রায় ১.২ বিলিয়ন পাউন্ড লোকসান হবে। প্রতিবাদ শুরু হয় তখন থেকেই। ইয়াসুনির মানুষ তো বটেই, ইকুয়ডেরের সাধারণ মানুষও প্রতিবাদে পথে নামেন। গঠিত হয় ‘ওয়ারানি ইন্ডিজেনাস কমিউনিটি’। 

আরও পড়ুন
অরণ্যে পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে ‘গাছের চোখ’

২০১৯-এ ইকুয়েডরের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, আমাজনের অরণ্য কেটে তেল উত্তোলন নিষিদ্ধ করতে হবে। তাতেও কাজ থেমে থাকেনি। অবশেষে গণভোটের দ্বারস্থ হয়েছে ইয়াসুনিডো গোষ্ঠী। প্রশ্ন একটাই ইয়াসুনি থেকে রাষ্ট্র তেল উৎপাদন বন্ধ করবে কিনা? 

আরও পড়ুন
নিবার্চনের আবহে এক ধাক্কায় অরণ্যনিধন বৃদ্ধি ব্রাজিলে!

এ বছরের মে মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গুইলের্মো লাসো-র বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগ ওঠার পরেই গণভোটের ঘোষণা করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ইয়াসুনিডো-র ১৪০০ স্বেচ্ছাসেবী দেশ জুড়ে প্রায় ৭৫৭০০০ সই সংগ্রহ করেছে। ভোটসমীক্ষাও বলছে ৯০ শতাংশ ইকুয়েডরবাসী তাঁদের পক্ষেই মত দেবে। 

কিন্তু সাম্প্রতিক একটি ঘটনা তাঁদের মাথায় চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এক সপ্তাহ আগেই খুন করা হয় বিরোধী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতদিন বিষবাক্য প্রয়োগ করা হচ্ছে ইয়াসুনিডো-র বিরুদ্ধে। ফলে নির্বাচনের প্রক্রিয়া আদৌ স্বচ্ছ হবে কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় তাঁরা। 

যদি হেরে যায়, শুধু কি পরিবেশ বিপন্ন হবে? একই সঙ্গে ধ্বংস হবে অরণ্যাণী মানুষের নিশ্চিন্ত জনজীবন। এতদিনের আন্দোলন হার মানবে পুঁজির কাছে। নির্জীব হয়ে যাবে প্রতিবাদের কণ্ঠ। কর্পোরেট সংস্থা নিয়ে আসবে পরিকল্পিত দারিদ্র্য। যুবসমাজের জন্য থাকবে ড্রাগের ব্যবস্থা। শুরু হবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সরকার থেকে এর আগেও বলা হয়েছিল তেল উত্তোলন দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। আদতে সমৃদ্ধি পেয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লোক। 

আসলে পৃথিবী সংকটে নয়। সংকটে মানুষ। প্রকৃতির নির্বিচারে হত্যা ধ্বংস করে দেবে মানবপ্রজাতিকে। প্রকৃতি তারপর নতুন করে সেজে উঠবে। ফলে আগামী রবিবারের লড়াই ইকুয়েডরবাসীর লড়াই শুধু ইয়াসুনি অরণ্যভূমির জন্য নয়, লড়াই নিজেদের জন্যও। ইয়াসুনিডো-রা কি জিতবে? নাকি আবার কোনো নতুন ফন্দি খুঁজে নেবে রাষ্ট্রশক্তি? আশঙ্কা থেকেই যায়।

Powered by Froala Editor