উপজাতি শিশুদের স্থানচ্যুত করে ডেনমার্কের 'পরীক্ষা', এক কলঙ্কিত ইতিহাস

কর্মসূত্রে কিংবা শিক্ষার জন্য নিজের শহর এমনকি দেশ ছেড়েও অন্যত্র পাড়ি দেন অনেকেই। ভাষা, জলবায়ু এবং সামাজিক পরিবর্তন তো বটেই, পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে ভিনদেশের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে কম-বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় সকলকেই। কিন্তু বোধশক্তি তৈরি হওয়ার আগেই যদি ছোট্ট শিশুদের এনে হাজির করা হয় সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে? তারা কি মানিয়ে নিতে পারবে নিজেদের? 

এই প্রশ্নের উত্তরে একাধিক তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তবে তত্ত্ব নয়, বরং খাতায় কলমে এই পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন ডেনমার্কের সমাজবিদ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বরা। চালিয়েছিলেন অমানবিক এক সামাজিক পরীক্ষা।

১৯৫১ সালের কথা। তখনও গ্রিনল্যান্ড (Greenland) ডেনমার্কের (Denmark) উপনিবেশ। বৃহত্তম দ্বীপরাষ্ট্রটির প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবেই রয়েছে ডেনমার্কের হাতে। তবে উপকূলবর্তী কয়েকটি শহরের কথা বাদ দিলে, গ্রিনল্যান্ড তখনও আটকে রয়েছে উনিশ শতকে। মূলত, মাছ ও বন্যপ্রাণী শিকার করেই জীবনযাপন করেন স্থানীয় ইনুইট উপজাতির মানুষরা। বাসস্থান বলতে, ইগলু কিংবা কুঁড়ে ঘর। তাঁরা অর্থের ব্যবহার করেন না বললেই চলে। পাশাপাশি ড্যানিশ শহরগুলি ছাড়া সেইভাবে গোটা দেশে শিক্ষার পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি তখনও। 

এই পরিস্থিতির বদল এনে আধুনিকতর গ্রিনল্যান্ড তৈরির লক্ষ্যেই উদ্ভট সামাজিক পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন ঔপনিবেশিক শাসকরা। ঠিক করা হয়, গ্রিনল্যান্ড থেকে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ইনুইট (Inuit Children) কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে যাওয়া হবে ডেনমার্কে। শেখানো হবে ড্যানিশ ভাষা। যাচাই করে দেখা হবে, মাতৃভূমি ছেড়ে ডেনমার্কের নতুন পরিবেশে কতটা তারা মানিয়ে নিতে পারে। আর যদি এই পরীক্ষা সফল হয়, তবে ভবিষ্যতে ড্যানিশ শাসকদের হয়েই গ্রিনল্যান্ডে প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলাবে তারা। আনবে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন।

আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’

গ্রিনল্যান্ডের মিশনারিগুলিকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং ডেনমার্কের রানি। সেই আদেশ অনুযায়ী, অভিভাবকদের বড়ো অঙ্কের অর্থ এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লোভ দেখিয়ে মেধার নিরিখে সামনের সারিতে থাকা ২২ জন শিশুকে স্থানান্তরিত করা হয় ডেনমার্কে। তবে প্রাথমিকভাবে সভ্যতার সংস্পর্শে আসতে দেওয়া হয়নি তাদের। তাদের জায়গা হয়েছিল কোপেনহেগেন থেকে কয়েক মাইল দূরে নির্জন প্রান্তরের এক খামার বাড়িতে। আদতে যা ছিল কোয়ারেন্টাইন। 

আরও পড়ুন
‘ডাস্টবিন স্কুল’-এ পাঠানো হত কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের, প্রকাশ্যে ইংল্যান্ডের অমানবিক ছবি

ড্যানিশ ভাষা শিখে যাওয়ার পর, তাদের পুনর্বাসিত করা হয় ডেনমার্কের পৃথক পৃথক শহরের পালক পরিবারে। বলার অপেক্ষা থাকে না, ভিনদেশে সৎবাবা-মায়ের কাছে বড়ো হয়ে ওঠা খুব একটা সুখকর ছিল না তাদের পক্ষে। অধিকাংশ শিশুকেই শিকার হতে হয়েছিল সামাজিক হিংসা, অত্যাচারের। ইনুইট ভাষা উচ্চারণ করলেও মিলত কঠিন শাস্তি। সেইসঙ্গে নতুন পরিবেশে মিশেলস, টিউবারকিউলোসিস-সহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন অনেকেই। 

আরও পড়ুন
দিনের পর দিন শিশুদের বেঁধে রাখা হয় শিকলে, অমানবিক রীতি নাইজেরিয়ায়

১৯৫৩ সালে গ্রিনল্যান্ডকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয় ডেনমার্ক। আর তারপরেই, ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ডে ফিরিয়ে আনা হয় ১৬ জন ইনুইট শিশুকে। বাকিদের দত্তক নিয়েছিল বিভিন্ন ড্যানিশ পরিবার। তবে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেনি ইনুইট শিশুরা। ততদিনে তাদের কথ্য ভাষা হয়ে উঠেছে ড্যানিশ। স্মৃতি থেকে মুছে গেছে স্থানীয় ইনুইট ভাষা। ফলে, স্থানীয় মানুষ তো বটেই, নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলাও সম্পূর্ণ অপরিচিত বলেই মনে হত তাদের। পাশাপাশি আবার ইনুইট ভাষা আয়ত্ত করার পথটাও বন্ধ করে দিয়েছিল ডেনমার্ক প্রশাসন। পরিবার নয়, বরং তাঁদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল ডেনমার্কের পরিচালিত বিভিন্ন মিশনারি এবং অনাথআশ্রমে। অত্যাচার চলত সেখানেও।

প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার পর তাদের কাজ দেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিনের এই মানসিক নিপীড়নে তারা অধিকাংশই আসক্ত হয়ে পড়েছিল মাদকসেবনে। ফলাফল, স্বল্প বয়সেই মৃত্যু। সংশ্লিষ্ট ২২ জন শিশুর মধ্যে বর্তমানে বেঁচে রয়েছেন মাত্র ৬ জন। যদিও, তৎকালীন সময়ে ‘এক্সপেরিমেন্টেট’-খ্যাত এই সামাজিক পরীক্ষাকে ‘সাফল্য’ বলেই তুমুল প্রচার করেছিল ডেনমার্ক সরকার এবং ড্যানিশ সংবাদমাধ্যম। তবে বিরুদ্ধ-মতও ছিল। গড়িয়েছিল বিতর্কের জল।

প্রায় সাত দশক বছর পেরিয়ে এসে, আজও প্রাণবন্ত সেই বিতর্ক। না, এখনও যথাযথ বিচার পাননি অমানবিক এই পরীক্ষার শিকার হওয়া গ্রিনল্যান্ডের ইনুইটরা। ২০১৪ সালে ডেনমার্কের সরকার-বিরোধী রাজনৈতিক দল সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দিলেও, মুখের কথা হয়েই থেকে গেছে সেই আশ্বাস। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধামাচাপা পড়ে গেছে ট্রাইবুনালের মামলাও। কেবলমাত্র বছর খানেক আগে সাংবাদিক সম্মেলনে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি, শৈশব ও স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নেওয়ার ক্ষতিপূরণের দাবিতে ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠালেও যোগ্য উত্তর পাননি তাঁরা। আদৌ কি জীবিত অবস্থায় এই মামলার নিষ্পত্তি দেখে যেতে পারবেন তাঁরা? ঝুলে রয়েছে প্রশ্ন চিহ্ন…

Powered by Froala Editor