১৩০ বছরের পুরনো তত্ত্বকে পরীক্ষাগারে কাজে লাগিয়ে নোবেলজয় দুই রসায়নবিদের

কোভিড পরিস্থিতিতে তো বটেই, অন্য সময়েও ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। করোনার মতো মারাত্মক না হলেও ভাইরাস ও অণুজীবের প্রকোপ তো সবসময় লেগেই আছে। তবে আজও অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে কিছুটা আতঙ্ক থেকেই গিয়েছে। অধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ শরীরে যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে। আর তার সবচেয়ে বড়ো কারণ এর মধ্যে উপস্থিত ভারী ধাতুগুলি। ওষুধের কার্যকারিতা বাড়াতে অনুঘটক হিসাবে এইসব ধাতু ব্যবহার করতেই হত। তবে এখন অবস্থাটা বদলেছে। আর এই বদলের কারিগর দুই বিজ্ঞানীকেই এ-বছর সম্মান জানাল নোবেল ইনস্টিটিউট। ২০২১ সালের রসায়নের নোবেল পুরস্কার (Nobel Prize) পেলেন জার্মান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট এবং আমেরিকা নিবাসী স্কটিশ বিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকমিলান।

অনুঘটক হিসাবে শুধুই ধাতু বা উৎসেচক নয়, আরও নানা ধরনের জৈব অণুকেই যে কাজে লাগানো যায়, তাই পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন এই দুই বিজ্ঞানী। তাত্ত্বিকভাবে অবশ্য বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকেই। ১৮৬৯ সালে রুশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার বোরোডিন এবং ১৮৭২ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী চার্লস অ্যাডলফ উয়ার্ৎজ আলাদা আলাদাভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন অপ্রতিসম জৈব অনুঘটকের কাজ। সমীকরণ কষে দেখিয়েছিলেন অ্যালডিহাইড এবং অ্যালকোহলের কার্বন-কার্বন বন্ধন কীভাবে কোনো বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। সমীকরণ তো প্রমাণিত হল। কিন্তু যা হাতে-কলমে প্রমাণ করা যায় না, রসায়নবিদ্যার কাছে তো তার কোনো গুরুত্বই নেই। প্রত্যক্ষ প্রমাণও অবশ্য খুঁজে পেলেন দুজনেই। নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়ার শরীরে এই বিক্রিয়া অনবরত ঘটে চলেছে। এমনকি মানুষের শরীরেও তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে পরে। কিন্তু তারপরেও পরীক্ষাগারে এমন অনুঘটক তৈরি করা সম্ভব হয়নি। আর তাই ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ভরসা রাখতে হয়েছে বিভিন্ন ধাতুর উপরেই।

এরপর কেটে গিয়েছে ১৩০ বছর। অবশেষে ২০০২ সালে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হল একটি গবেষণাপত্র। গবেষণাপত্রটির নাম, ‘দ্য ফার্স্ট ডিরেক্ট অ্যান্ড এনালসিওসিলেক্টিভ ক্রস-অ্যাডল রিয়্যাকশন অফ অ্যালডিহাইডস’। মার্কিন প্রবাসী স্কটিশ বিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকমিলান পরীক্ষাগারে কৃত্রিম উপায়ে অ্যাডল রিয়্যাকশন সম্ভব করে দেখালেন। তবে সেটা গবেষণার প্রথম ধাপ মাত্র। এরপর ২০০৪ সালে জার্মান বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিস্ট প্রথম অ্যালডিহাইডের আলফা-অ্যালকাইলেশনে কাজে লাগালেন অপ্রতিসম জৈব অনুঘটককে। আপাতভাবে খুবই সামান্য কাজ মনে হতে পারে। প্রকৃতিতে যা কয়েক কোটি বছর ধরে ঘটে আসছে, তাকেই যথাযথভাবে পরীক্ষাগারে প্রয়োগ করা গেল মাত্র। তবে এই সামান্য কাজটি করতেই লেগে গিয়েছে দীর্ঘ ১৩০ বছর। আর তার তাৎপর্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজও বেড়ে চলেছে। অ্যান্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে অ্যান্টাসিড বা মানসিক অবসাদের ওষুধ, আজকাল সবকিছুতেই অপ্রতিসম জৈব অনুঘটকের ব্যবহার বাড়ছে। তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, এই ধরনের অনুঘটকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম। অনুঘটক মাত্রেই তা শরীরে জমে থাকবে। কিন্তু শরীরে ভারী ধাতু জমে থাকার ফলে যে সমস্ত জটিলতা দেখা দেয়, তার প্রায় কিছুই এইসমস্ত ক্ষেত্রে দেখা যায় না। লিস্ট এবং ম্যাকমিলানের গবেষণার সূত্র ধরে আজও কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কাজ সত্যিই সুদূরপ্রসারী। আর সেই গবেষণার কাণ্ডারি দুই বিজ্ঞানীকেই স্বীকৃতি জানাল নোবেল কমিটি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More