প্রয়াত সিপিআই(এম)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, শতায়ু বামনেত্রী গৌরী আম্মা

১৯৬৭ সাল। কেরলে তখন ই.এম.এস. নাম্বুদিরিপাদের সরকার। সে বছর পাশ হল দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা ঐতিহাসিক ভূমি সংস্কার আইন। তার দরুন মাথার ছাদ জুটল প্রায় ৩৫ লক্ষ ভাড়াটিয়ার। প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশি কৃষকরা পেলেন চাষের জমি। আর পরেও প্রায় এক লক্ষ একর জমি উদ্বৃত্ত হিসাবে ঘোষণা করেছিল কেরল সরকার। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কেরালায় অবলুপ্ত হয় জমিদার প্রথা। ঐতিহাসিক এই আইনের পুরোধা ছিলেন কেরলের সমাজকল্যান ও রাজস্ব মন্ত্রী কে.আর. গৌরী থমাস। পূর্ববর্তী সরকার কর্তৃক প্রস্তুত করা বিলের বেশ কিছু পরিবর্তন করে, তা কার্যকরী করে তুলেছিলেন তিনিই।

তবে কেরলে সাধারণের কাছে তিনি পরিচিত গৌরী আম্মা নামেই। গতকাল ১০১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন জনপ্রিয় বামনেত্রী। বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনীত সমস্যায় ভুগছিলেন গৌরী আম্মা। মঙ্গলবার সকালে কেরলের এক বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ই.এম.এস. নাম্বুদিরিপাদ সরকারের শেষ জীবিত সদস্য ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শেষ হল কেরলের ঐতিহাসিক বাম আন্দোলনের একটি অধ্যায়।

কেরলের আলাপুঝা জেলার পট্টনাক্কড় গ্রামে প্রভাবশালী এঝাভা পরিবারে জন্ম গৌরী আম্মার। বাবা ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবী। যদিও এঝাভা সম্প্রদায়কে নিম্নশ্রেণি হিসাবেই চিহ্নিত করত স্থানীয় মানুষজন। টেরেসা কলেজ থেকে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেন তিনি। তারপর বাবার কর্মজীবনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বেছে নেওয়া আইনের পথ। ভর্তি হওয়া গভার্নমেন্ট ল’ কলেজে। উল্লেখ্য, তিনিই ছিলেন পিছিয়ে পড়া এঝাভা সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা আইনজীবী ও আইনের ছাত্রী। 

ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ভারতে তখন ব্রিটিশ শাসন। গান্ধীজির মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে তিনি অংশ নিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। ধরাও পড়লেন ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। নৃশংস অত্যাচার চলল তাঁর ওপর। তবুও দমানো গেল না তাঁকে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার সেই আন্দোলনের পথেই হাঁটলেন তিনি। এমনকি স্বাধীন ভারতেও প্রতিবাদের জন্য একাধিকবার হাজতবাস করতে হয়েছে তাঁকে।

আরও পড়ুন
কমনের যে ইষ্ট করে ও অন্যান্য

স্বাধীনতার পরেও আঁকড়ে রইলেন সেই রাজনৈতিক মাটিই। তবে বদলে গেল অবস্থান। কংগ্রেস নয়, বরং বাম চিন্তাধারাই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের মন্ত্র। তখনও কেরালা বলে কোনো পৃথক রাজ্য জন্ম নেয়নি ভারতে। ১৯৫২ সাল সেটা। ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন অ্যাসেম্বলিতে বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হলেন তিনি। ১৯৫২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবেই নির্বাচনে জিতে এসেছেন গৌরী আম্মা। বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ১১ বার। ২০১১ সালের পর বার্ধক্যজনিত কারণে ভোটের মঞ্চ থেকে সরে আসেন তিনি। তবে তারপরেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি রাজনীতির সঙ্গে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও বাম জোটের শরিক ‘জনাধিপত্য সংরক্ষণ সমিতি’-র সাধারণ সম্পাদকের পদ সামলেছেন তিনি। 

আরও পড়ুন
হেনস্থার শিকার কেরালার প্রথম রূপান্তরকামী প্রার্থী অনন্যা, সরে দাঁড়ালেন নির্বাচন থেকে

পরে ১৯৫৭ সালে ই.এম.এস. নাম্বুদিরিপাদের সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তিনিই ছিলেন কেরলের প্রথম মহিলা বিধায়ক। ছিলেন খাওয়া মানুষের জননেত্রী। আর সেই কারণেই কেরলে বাম সরকার ক্ষমতায় থাকুক কিংবা না থাকুক, অটুট ছিল তাঁর গ্রহণযোগ্যতা। কেরলে যখন ভূমি সংস্কার আইন প্রবর্তিত হয়, তখনও এক বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন তিনি। জমিদারদের জমি অধিগ্রহণের আগে, পরিবারের ১৩২ একর জমি তিনি দান করেন সরকারকে। 

আরও পড়ুন
‘যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করতেন, তাঁরাই এখন পৈতে বের করছেন’ : মনোরঞ্জন ব্যাপারী

তখন সদ্য ভাগ হয়ে গেছে কমিউনিস্ট পার্টি। তৈরি হয়েছে সিপিআই এবং সিপিআই(এম)। কেরলে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালের সেই বিভাজনের রেষ পড়েছিল তাঁর সংসারেও। দলগত মত পার্থক্যের জন্য বিচ্ছেদ হল স্বামী টি.ভি. থমাসের সঙ্গে সম্পর্ক। সংসার ভাঙল, তবুও মতাদর্শে অনড় তিনি। অন্যদিকে তাঁর স্বামী টি.ভি. থমাস তখন সিপিআই-এর মন্ত্রী। তিরুঅনন্তপুরমে পাশাপাশি দুটি পৃথক সরকারি ভবনে থাকতেন তাঁরা। 

তবে যে দলের জন্য সংসার ছাড়া, সেই দলও তাঁকে বহিষ্কার করল ১৯৯৪ সালে। বিধিভঙ্গের অভিযোগ আনা হল তাঁর বিরুদ্ধে। তারপরেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব দল ‘জনাধিপত্য সংরক্ষণ সমিতি’। সে-সময় সাময়িকভাবে ইউডিএফের সঙ্গে জোট বাঁধলেও পরে বামপন্থী জোটেই ফিরে আসেন তিনি। জীবনের শেষ সময় অবধি সেই মতাদর্শকে সামনে রেখেই পথ চলেছেন গৌরী আম্মা।

আট দশকের রাজনৈতিক জীবনে সব মিলিয়ে পৃথকভাবে চার দফায় মন্ত্রী ছিলেন গৌরী আম্মা। তাঁর হাত ধরেই শক্তিশালী হয়েছিল মহিলা ক্ষমতায়নের পথ। তৈরি হয়েছিল কেরলের প্রথম আইটি পার্ক। যেখানে কর্মসংস্থান হয় দশ হাজারেরও বেশি যুবক-যুবতীর। 

মৃত্যুর আগে বাম জোট এলডিএফের জয় দেখে গেলেন তিনি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ না নিলেও বামপন্থীদের কাছে তিনি ছিলেন অভিভাবক সময়। তাঁর মৃত্যুতে শূন্যস্থান তৈরি হল সেই জায়গাতেই। 

Powered by Froala Editor