‘যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করতেন, তাঁরাই এখন পৈতে বের করছেন’ : মনোরঞ্জন ব্যাপারী

সারা পৃথিবীতে যখন হিংসা এবং বৈষম্য এক চরম বাস্তব পরিস্থিতি হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি। কিন্তু সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দানা বাঁধছে বিতর্কও। কলকাতার প্রথম সারির এক সাহিত্যিক খানিক মজার ছলেই গতকাল সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ব্রাহ্মণ সাহিত্য অ্যাকাডেমিও তৈরি হোক। কিন্তু সেই ‘মজা’টি উপভোগ্য হয়ে ওঠেনি অনেকের কাছেই। বরং মনোরঞ্জন ব্যাপারীর প্রতিক্রিয়া তীব্র - “এঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করতেন আগে। এখন তাঁরা গলার পৈতে বের করছেন। যেহেতু মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তিরা শক্তিশালী হয়ে উঠছেন, তাই সেই শিবিরে আশ্রয় নিতে চাইছেন। এতকাল তাঁরা জাতপাতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এখন আবার সেখানেই এঁটো পাতা চাটতে চাইছেন।”

মনোরঞ্জন ব্যাপারী এই তৈরি হতে চলা দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির প্রথম চেয়ার-পার্সন। তবে এখানেই তাঁর পরিচয় শেষ হয়ে যায় না। বাংলা সাহিত্যের জগতে দলিতদের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর পরিচিতি কয়েক দশক ধরেই। আত্মজীবনী ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর সূত্রে দেশভাগ থেকে নকশাল আন্দোলন জুড়ে তাঁর বেড়ে ওঠার কঠিন লড়াইয়ের গল্প পড়েছেন অনেকেই। আর তার মধ্যেই বইকে আঁকড়ে ধরা। দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যসভায় গলায় গামছা নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। আসলে সব জায়গায় নিজের পরিচয়টাই জোর গলায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তিনি। আর এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে তিনি তাই বলে ওঠেন, “আমাদের জায়গা না দিয়ে তোমরা অন্যায় করেছ। আজকে আমরা যখন নিজেদের আত্মপ্রকাশের জায়গা খুঁজছি, তখন তুমি আমাদের সহযোগিতা করো। তাহলে বোঝা যাবে তুমি উদার মনস্ক।”

আসলে দলিত সাহিত্যকে তিনি একটা আলাদা ঘরানা হিসাবে দেখতেই আগ্রহী। যেখানে অবহেলিত মানুষদের জীবনের প্রতিফলন ঘটবে সাহিত্যে। তাই তিনি বলেন, “আমার পরিকল্পনা আছে যে আমরা যেন এমন একটা লাইব্রেরি বানাতে পারি যেখানে দলিত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি উচ্চবর্ণের সাহিত্যিকদের দলিত জীবন নিয়ে লেখা বইও থাকবে। তবে এটা নিয়ে সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।” কিন্তু তার পরেও তাঁর মূল চিন্তার বিষয়, সাহিত্যের জগতে দলিতদের আত্মপ্রকাশের জায়গা করে দেওয়া নিয়েই। রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার, দ্য হিন্দু সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পরেও মনোরঞ্জন ব্যাপারী বলেন, “আমার লেখা কলকাতার কোনো প্রথম সারির পত্রিকা বা প্রকাশক ছাপতে চান না। আমারই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকিরা লেখার সাহস পাবেন কীভাবে?” তিনি আরও বলেন, “একটা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাংলা সাহিত্যের স্তম্ভ হয়ে থেকে গিয়েছে। ওরা জানে আমরা লিখতে শুরু করলে এরকম অনেক লেখাই লিখতে পারি। তাই ওরা ভয় পায়। সাহিত্যের জগতে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আসন নড়ে যাওয়ার ভয় পায়।”

দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি সেইসব অবহেলিত সাহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের জায়গা হয়ে উঠবে, এবিষয়ে আশাবাদী তিনি। যদিও এখনও পুরোটাই আলোচনার জায়গায় আছে। সরকারের অর্ডার এসে পৌঁছয়নি এখনও। তাই পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “দেখতে হবে সরকারের কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাই।” কিন্তু ২৩ বছর ধরে দক্ষিণ কলকাতার একটি মূক-বধির স্কুলের হোস্টেলে রান্নার কাজ করতে করতেই দাঁতে দাঁত চেপে যে লড়াই তিনি করে চলেছেন, তার স্বীকৃতি পেলেন অবশেষে। সেইসঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন যাতে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়, তারও একটা জায়গা তৈরি হতে চলেছে। জাতিবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইতে এই উদ্যোগ একটা ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More