বেসরকারিকরণের থাবা বেঙ্গল কেমিক্যালসেও; হারাতে বসেছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মূলমন্ত্রই!

গত জুলাই মাস থেকেই দেশের বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি কেন্দ্র প্রকাশ করল সেই তালিকা। বেসরকারিকরণের তালিকায় থাকায় ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে নাম জড়াল শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল কেমিক্যালসেরও।

জনকল্যাণ, বেকারদের কর্মসংস্থান এবং বিদেশি শক্তির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানো— এমই স্বপ্ন নিয়ে এই কারখানা গড়ে তুলেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ১৮৯২ সালে শুরু হয়েছিল এই পথ চলা। তখন অবশ্য তার নাম ছিল ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস ওয়ার্ক’। ১৯০১ সালে ভারতের প্রথম ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’। মাঝের ১২০ বছরের ইতিহাসে বারবার ভারতের ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেঙ্গল কেমিক্যাল। 

স্বাধীনতার পর পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই অর্থনৈতিক একটা টানাপড়েন শুরু হয়েছিল এই কারখানায়। ১৯৭৭ সালে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে এই কারখানাকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। মর্যাদা দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিসাবে। পরে ১৯৮০ সালে বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডকে জাতীয়করণ করে তৎকালীন সরকার।

তবে তারপরেও কাটেনি অর্থনৈতিক সংকট। টানা কয়েক দশক ধরেই লোকসানের মধ্যে ডুবে ছিল এই ওষুধ প্রস্তুতকারক কারখানা। আর তা হবে নাই বা কেন? সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখেই স্বল্পমূল্যে ওষুধ এবং স্যানিটাইজেশনের সামগ্রী বাজারে আনাই যে মূলমন্ত্র বেঙ্গল কেমিক্যালসের। তাই সামান্যতম লাভ রেখেই এই প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়েছে সংস্থাটি।

তবে ২০১৬-১৭ সাল থেকে আবার ব্যবসায় ফিরতে শুরু করেছিল বেঙ্গল কেমিক্যালস। যা শিখরে পৌঁছায় এই মহামারীর আবহেই। সম্প্রতি একদিনে প্রায় ৫২ হাজার বোতল ফিনাইল তৈরি করে রেকর্ডও গড়েছিল এই সংস্থা। জনপ্রিয়তা আদায় করে নিয়েছিল বেঙ্গল কেমিক্যালসে তৈরি স্যানিটাইজার ‘বেনস্যানি’-ও। চাহিদার সামাল দিতে কার্যত রাত-দিন এক করে কর্মীদের প্রচেষ্টার ছবি সামনে এসেছিল সকলের। 

কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছে এই ২৬টি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই লাভের মুখ দেখছে না। তাই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই এই সিদ্ধান্ত সরকারের। কিন্তু গত কয়েক বছরের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট, ক্ষতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে না বেঙ্গল কেমিক্যালস। যা উল্লেখিত হয়েছে খোদ সরকারের নথিতেই। তার পরেও কেন বেসরকারিকরণের আওতায় আনা হল এই সংস্থাকে, থেকে যাচ্ছে ধোঁয়াশা।

আরও পড়ুন
১২৮ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড বেঙ্গল কেমিক্যালের, এক দিনে উৎপাদিত ৫২ হাজার বোতল ফিনাইল

দেশের অর্থনীতির জন্য ভাইরাসের সংক্রমণকে সরকার দায়ী করলেও মহামারীর আগে থেকেই ভেঙে গিয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। লকডাউন এবং সংক্রমণ সেই ক্ষতকেই যেন আরও দগদগে করে তুলেছে। সেই ক্ষতেই খানিকটা প্রলেপ দেওয়ার জন্যই কি সরকারের এই সিদ্ধান্ত? ভারতের রাজকোষের ঘাটতিকে এককালীন বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজনের জন্যই কি সরকার বেছে নিল এই রাস্তা? লাভ থাকার পরেও তাই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে?

এসব প্রশ্নই ঘুরতে থাকছে সরকারের নতুন ঘোষণা ঘিরে। বিশ শতকে প্লেগ কিংবা বিশ্বযুদ্ধ, অন্যান্য মারণ রোগের সংক্রমণ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক করোনার সময়েও দেশের কাছে অন্যতম ত্রাতা হিসাবে পাশে দাঁড়িয়েছে বেঙ্গল কেমিক্যালস। হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনের চাহিদা মেটাতেও কেন্দ্র শরণাপন্ন হয়েছিল এই সংস্থারই। বেসরকারিকরণের পর সংস্থার উৎপাদিত প্রত্যেক সামগ্রীর মূল্য যে বৃদ্ধি পাবে, তাও কার্যত পরিষ্কার। যার প্রভাব পড়বে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের ওপরেই। পাশাপাশি লাভের পরিমাণ বাড়াতে কর্মীছাঁটাইয়ের মতো ঘটনার দিকেও ঠেকে দিতে পারে বেসরকারিকরণ। ফলে কেন্দ্রের এই তুঘলকি সিদ্ধান্তে বেঙ্গল কেমিক্যালসের বেসরকারিকরণ যে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে অর্থনীতিকেই ধাক্কা দিতে চলেছে, স্পষ্ট হয়ে আসছে সেই সম্ভাবনাই...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব আর বেসরকারিকরণ; অর্থনীতি কি দিশাহীন হয়ে পড়ছে ক্রমশই?

More From Author See More