সত্যজিতের সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্রের বাড়িতে ব্লু প্লেক, তৈরি হবে প্রদর্শনশালাও

কলেজের পড়ার সময় থেকেই তাঁকে টানত বিদেশি সিনেমা। কাজেই হলিউড চলচ্চিত্রের সাক্ষী হতে কলেজ কেটে হাজিরা দিতেন সিনেমা হলে। তারপর ফেরার পথে নিজের মনে মনেই নতুন করে সাজাতেন দৃশ্যগুলো। ক্যামেরা ঠিক কোন অবস্থায় থাকলে দৃশ্যটির চরিত্র বদলে যেত— দিবাস্বপ্নের মতোই কল্পনার জাল বুনতেন সেসব নিয়ে। তবে ফটোগ্রফি করার ঝোঁক থাকলেও উপায় নেই। ক্যামেরাই নেই যে তাঁর। তাবড় ক্যামেরাম্যানদের অনুরোধ করেও সুযোগ মেলেনি কখনো।

১৯৫০ সাল সেটা। হঠাৎই ম্যাজিক খেলে গেল তাঁর জীবনে। কলকাতায় তখন ‘দ্য রিভার’-এর শুটিং করছেন কিংবদন্তি ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়াঁ। অনেক অনুরোধের পর শুটিং-এ অবজার্ভার হিসাবে থাকার অনুমতি পেলেন তিনি। কাজ শেখার এর থেকে বড়ো সুযোগ আর কীই বা হতে পারে। লিপিবদ্ধ করলেন সিনেম্যাটোগ্রাফির বিস্তারিত নোট। তাঁর আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়ে রেনোয়াঁ আলাপ করিয়ে দেন তরুণ সত্যজিতের সঙ্গে। সিনেমার জগতে ঢুকে পড়া সেই প্রথম। হ্যাঁ, ‘পথের পাঁচালী’-র দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সেদিনের সেই একুশ বর্ষীয় তরুণই। 

সুব্রত মিত্র। অপরাজিত, জলসাঘর, চারুলতা, নায়ক, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অপুর সংসার কিংবা দেবীর মতো সিনেমার দৃশ্যলিখন অপূর্ণই থেকে যেত তাঁকে ছাড়া। সত্যজিৎ তো বটেই পাশাপাশি যেমস আইভরির একাধিক সিনেমাতেও সিনেম্যাটোগ্রাফারের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এমন একজন মানুষই ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন যেন। এবার তাঁকে অভিনব শ্রদ্ধা জানাল পশ্চিমবঙ্গের হেরিটেজ বোর্ড। বিগত জানুয়ারি মাসেই পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন শরৎ বোস রোডে অবস্থিত চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের বাসভবনকে ঘোষণা করেছিল ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য হিসাবে। এবার তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে স্থাপিত হল ব্লু প্লেক। 

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-বিধানচন্দ্র, ‘পথের পাঁচালী’ ও কিছু প্রচলিত ভুল তথ্য

তবে এখানেই শেষ নয়। কিংবদন্তি চিত্রগ্রাহককে নিয়ে যাতে চর্চার ধারা অব্যাহত থাকে, সেই দিকটার কথাও মাথায় রেখেছে হেরিটেজ কমিশন। আর সে জন্য ৭০ নম্বর শরৎ বোস রোডের সেই বাড়িটাতেই আস্ত প্রদর্শনশালা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে সেই কর্মযজ্ঞ। সেখানে রাখা হবে তাঁর ক্যামেরা, বাদ্যযন্ত্র ও ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিস। কাজের বিভিন্ন নথি, স্মারক এবং তাঁর হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবি। 

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-স্মরণে শর্টফিল্ম ফেস্টিভাল, আয়োজনে কলকাতার এক দল তরুণ চলচ্চিত্রকার

তবে খুব কিছু সহজ নয় এই প্রদর্শনশালা সাজিয়ে তোলার কাজ। কারণ, সুবিশাল এই পৈতৃক ভিটেতে একাই থাকতেন সুব্রত মিত্র। ফলত, তাঁর ব্যবহৃত ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিসপত্রগুলির মধ্যে সর্বত্রই সেখানে লেগে ছিল অযত্নের ছাপ। পাশাপাশি কিছুদিন আগেই বাড়ির মধ্যে পৃথকভাবে নির্মাণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়েরা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই বন্ধ করা গেছে সেই কাজ। তবে ঐতিহ্যবাহী বাড়ির পুরনো চেহারা ফিরিয়ে আনতে এখনও বেশ খানিক সময় লাগবে বলেই জানাচ্ছে হেরিটেজ কমিশন। সেইসঙ্গে আগামীতে সুব্রত মিত্রের বাসভবনের রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত দায়িত্ব নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজ্য। 

আরও পড়ুন
হেরিটেজ তকমা পেল অপু-ত্রয়ীর ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্রের বাড়ি

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রজগতে বাংলা ছবিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারিগরদের মধ্যে একজন ছিলেন সুব্রত মিত্র। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা হয়তো চিরকালই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি পরিচালককেই। শুধু যে আলোকচিত্রগ্রাহক ছিলেন সুব্রত মিত্র, তেমনটা নয়। ‘নায়ক’ সিনেমায় সেই বিখ্যাত ট্রেনের দৃশ্যটির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? সেটি সেজে উঠেছিল তাঁর হাতেই। ‘পথের পাঁচালী’-ও রঙিন হয়ে উঠেছিল তাঁর বাজানো সেতারের সুরে। এক কথায় যাকে বলে বহুমুখী প্রতিভা। জাতীয় পুরস্কার এবং পদ্মশ্রী পেলেও ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত থেকে যান তিনি। ২০০১ সালে মনোনীতদের তালিকাতেও ছিল তাঁর নাম। কিন্তু ওই বছরই বিদায় নেন কিংবদন্তি সিনেম্যাটোগ্রাফার। তারপর? তারপর যেন ক্রমশ নিজেদের শহরই ভুলে গেছে তাঁকে। রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগে আবার নতুন করে সাধারণের মধ্যে সিনেমাচর্চায় উঠে আসতে চলেছে তাঁর নাম। এর থেকে বড়ো আর কিছুই যে হতে পারে না…

Powered by Froala Editor

Latest News See More