ফের দুঃসংবাদ, চলে গেলেন বঙ্গরাজনীতির 'ছোড়দা' সোমেন মিত্র

ফের নক্ষত্রপতন! এবারে জটিল কিডনির অসুখ প্রাণ কেড়ে নিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রর। এই খবরে বাংলা তথা জাতীয় রাজনীতি মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে স্বাভাবিক নিয়মেই।

শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় কয়েকদিন আগে সোমেনবাবুকে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল। পুরনো পেসমেকার বদলের কথা ছিল। সেইসঙ্গে কিডনির সমস্যা গুরুতর হয়ে ওঠায় চলছিল ডায়ালিসিসও। সোমেন মিত্রর শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও খোঁজ নিয়েছিলেন তাঁর। তাঁর পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও। নার্সিং হোম সূত্রে গতকাল জানানো হয়েছিল, সোমেন মিত্রর অবস্থা স্থিতিশীল, তবে সংকট কাটেনি। এরপর, রাতেই ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তারপরই গভীর রাতে আসে দুঃসংবাদ। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, ৭৯ বছর বয়সেই থামতে হল বাংলা রাজনীতি মহলের ‘ছোড়দা’-কে। রেখে গেলেন স্ত্রী শিখা মিত্র এবং পুত্রসন্তান রোহন মিত্রকে। 

সৌমেন্দ্র নাথ মিত্র তথা সোমেন মিত্রর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোরে, পরে ঠিকানা কলকাতা। সিটি কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক, তারপরে এলএলবি পাশ। সক্রিয় রাজনীতি শুরু যৌবনেই। দক্ষ সংগঠক হিসেবে কংগ্রেসের সামনের সারির নেতা হয়ে উঠতে বিশেষ সময় লাগেনি। বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে ১৯৭২ সালে শিয়ালদহ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবার জয়। তারপর ২০০৬ সাল অবধি টানা বিধায়ক। বাম আমলেও তাঁর ‘রাজত্ব’ টাল খায়নি, ভাটা পড়েনি জনপ্রিয়তাতেও। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে জয়ী। মৃত্যুর আগেও ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। উত্তর কলকাতা-সহ বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় গভীর প্রভাব ছিল বঙ্গ রাজনীতির ‘ছোড়দা’-র। আর্মহার্স্ট স্টিট অঞ্চলের একটি বিখ্যাত কালীপুজোর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। খেলা ভালোবাসতেন, বিশেষ করে ক্রিকেট আর ফুটবল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া ছিল তাঁর নিত্যদিনের অভ্যেস। 

সোমেন মিত্রর রাজনৈতিক জীবনে বাঁকবদল হয়েছে একাধিকবার। একসময় তাঁর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাজনৈতিক মতপার্থক্য’ বঙ্গরাজনীতিতে বহুল চর্চিত বিষয় ছিল। তখন দু’জনেই জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য। এরপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করলেন সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে প্রদেশ কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সোমেন মিত্র প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব দল ‘প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস’। এরপর যোগ দেন একদা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে গড়া দল তৃণমূল কংগ্রেসে। নতুন দলে শুরুতেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাঁকে। ডায়মন্ড হারবারের মতো কঠিন কেন্দ্রে তাঁকে প্রার্থী করে পাঠিয়েছিলেন মমতা। সেই সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত হতে দেননি সোমেন। সিপিআইএম-এর দাপুটে নেতা চারবারের সাংসদ শমীক লাহিড়ীকে পরাজিত করেছিলেন বেশ ভালো ব্যবধানে। কিন্তু তৃণমূলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০১৪ সালে ফের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। কিন্তু নিজের পুরোনো পার্টিতে প্রত্যাবর্তনের পরে আর নির্বাচনে জয়ের স্বাদ পাননি সোমেন।

প্রদেশ কংগ্রেস এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে খুব স্বস্তির জায়গায় নেই। অসংখ্য নেতা ইতিমধ্যেই দল ছেড়েছেন। শেষ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট উত্তরবঙ্গের শক্ত ঘাঁটিতেও জমি হারিয়েছে দল। সেখানে মাথা তুলেছে পদ্মফুল। দলের মধ্যে অন্তর্কলহও স্পষ্ট হচ্ছিল নানা সময়ে। দ্বিতীয়বারের মতো প্রদেশ কংগ্রস সভাপতি হওয়ার পরে সোমেন মিত্রর সামনে চ্যালেঞ্জ নেহাত সহজ ছিল না। পরের বছর বিধানসভা নির্বাচনে পার্টির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চাপও ছিল। সোমেন তাঁর মতো করে চেষ্টা করছিলেন। সিপিআইএমের সঙ্গে যৌথ আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ জোটগঠনের প্রক্রিয়াও চলছিল। কিন্তু এই যুদ্ধে শরীর তাঁকে সঙ্গত দিল না।

বাংলা রাজনীতি তাঁর এক বর্ণময় চরিত্রকে হারাল!

আরও পড়ুন
চলে গেলেন বাংলাদেশের 'প্লেব্যাক সম্রাট' এন্ড্রু কিশোর, শোকাহত অসংখ্য অনুরাগী

Powered by Froala Editor