ঠুড়গা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পে ধ্বংস হবে প্রস্তরযুগের প্রত্নক্ষেত্রও, সরব পরিবেশকর্মীরা

“ঠুড়গা বাঁদু কাঁঠলাজোল প্রজেক্ট হয়ে গেলে হয়তো আমরা চিরতরে হারাব আমাদের ঐতিহাসিক সম্পদ।” এমনটাই মনে করছেন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সৌরভ প্রকৃতিবাদী। প্রায় দেড় দশক ধরে আযোধ্যা পাহাড়ের এই বিদ্যুৎ প্রকল্পকে ঘিরে আন্দোলন চলে আসছে। পরিবেশের পাশাপাশি উঠে আসছে আদিবাসী মানুষদের অরণ্যের অধিকারের প্রশ্নটিও। আর সেইসঙ্গে ইতিহাসের প্রশ্নটাই বা অস্বীকার করা যায় কী করে? আর সেই ইতিহাস অন্তত ৩০-৪০ হাজার বছরের পুরনো। এই অযোধ্যা পাহাড়ের নিচেই ঘুমিয়ে রয়েছে প্রাচীন প্রস্তরযুগের শিকারী মানুষের জীবনযাপনের ছবি।

আজ থেকে ৭ বছর আগে ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল একটি গবেষণাপত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বিষ্ণুপ্রিয়া বসাকের গবেষণায় জানা গিয়েছিল, পুরুলিয়া জেলার কানা এবং মহাদেববেড়া গ্রামের নিচেই রয়েছে এক অতি প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র। আর তার প্রমাণ হিসাবে অধ্যাপক বসাক খুঁজে পেয়েছিলেন কিছু মাইক্রোলিথ। মাইক্রোলিথ হল পাথরের তৈরি ব্লেড। এগুলি লম্বায় বড়োজোর ৩-৪ সেন্টিমিটার এবং চওড়ায় তার এক তৃতীয়াংশ হত। আদিম মানুষের শিকারের প্রথম হাতিয়ার মাইক্রোলিথ। নানা আকাড়ের মাইক্রোলিথ কাঠ বা হাড়ের দণ্ডের সঙ্গে গেঁথে নিয়ে তৈরি হত বর্শা, ছুরি, ক্ষুর বা পরবর্তীকালে তিরের মতো অস্ত্র।

কিছু বিক্ষিপ্ত মাইক্রোলিথ নয়, অধ্যাপক বিষ্ণুপ্রিয়া বসাক খুঁজে পেয়েছিলেন দুটি আস্ত কারখানা। পরীক্ষায় দেখা যায়, কানা গ্রামের আশেপাশে পাওয়া মাইক্রোলিথগুলির বয়স প্রায় ৪২ হাজার বছরের বেশি। অন্যদিকে মহাদেববেড়ার আশেপাশে পাওয়া অস্ত্রগুলিও প্রায় ২৫-৩০ হাজার বছরের পুরনো। এর আগে মধ্যপ্রদেশের মেটাখেরি এবং অন্ধ্রপ্রদেশের জোয়ালাপুরমে মাইক্রোলিথের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলির বয়স আনুমানিক ৪৮ হাজার এবং আনুমানিক ৩৫ হাজার বছর। মধ্যভারতের নানা স্থানে গবেষণা করে আদিম মানুষের নানা সাক্ষ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। তবে ছোটনাগপুরের মালভূমির পাদদেশেও যে একই সময়ে মানুষের বসবাস শুরু হয়েছিল, তার প্রমাণ এই গবেষণা। কিন্তু ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন করে কোনো অনুসন্ধান হয়নি। বরং সেই প্রত্নক্ষেত্রের উপরেই ২০০৬-০৭ সালে জাপানের জিকা কোম্পানির উদ্যোগে শুরু হয় পাম্প পাওয়ার স্টোরেজ তৈরির কাজ।

ঠুড়গা পাওয়ার স্টোরেজ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আজও লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানকার সাধারণ মানুষ। মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টেও। ঠিক দু-বছর আগে বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। তবু আজও বে-আইনিভাবে গাছ কাটা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সৌরভ প্রকৃতিবাদীর কথায়, “অযোধ্যা পাহাড় নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের ইতিহাসের শিকড়ও উপড়ে যাবে। অযোধ্যাকে যত বেশি জানা-জানানোর কাজ চলছে, ততই তীব্র হচ্ছে হারানোর হারানোর বোধ।”

Powered by Froala Editor