ফলবিক্রেতা থেকে সটান বলিউডের নায়ক, হয়ে উঠলেন রুপোলি পর্দার 'ট্র্যাজেডি কিং'

১৯৫৪ সাল। ভারতের প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মঞ্চে উঠলেন অভিনেতা। তাঁর নাম মহম্মদ ইউসুফ খান। অবশ্য এই নামে তাঁকে কেউই চেনেন না। কিন্তু এই নামে দর্শকরা চেনেন না কাউকেই। তাহলে কে এই ভারতসেরা অভিনেতা? পর্দায় তাঁর নাম ততদিনে বদলে গিয়েছে। তিনি দিলীপ কুমার। এখনও অবধি ভারতের সবচেয়ে বেশি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের প্রাপক তো বটেই, জনপ্রিয়তাতেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো নায়ক খুব কমই জন্মেছেন।

১৯২২ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে পেশোয়ার শহরে জন্মগ্রহণ করেন মহম্মদ ইউসুফ খান। শৈশবেই সপরিবারে চলে আসেন মুম্বাই শহরে। বছর দশেক বয়স থেকেই শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। এই সময় মুম্বাইয়ের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফল বিক্রি করতেন ইউসুফ। কিন্তু ততদিনে তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, সিনেমায় অভিনয় করবেন তিনি। একদিন এক পারিবারিক বন্ধুর দৌলতে আলাপ হয়ে যায় অভিনেত্রী দেবিকা রাণীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে বোম্বে টকিজের ঠিকানা নিয়ে সটান হাজির হলেন স্ক্রিন টেস্টের জন্য। আর প্রথমেই তাঁর পাঠানি উচ্চারণে মুগ্ধ হলেন দেবিকা রাণী। কিন্তু একটাই সন্দেহ ছিল তাঁর। মুসলমান ধর্মপরিচয়ের একজন নায়ককে মেনে নেবেন তো দর্শকরা?

মুশকিল আসান করলেন দেবিকা রাণী নিজেই। বদলে গেল নাম। মহম্মদ ইউসুফ খান হয়ে উঠলেন দিলীপ কুমার। ১৯৪৪ সাল। মুক্তি পেল তাঁর প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাঁটা’। তবে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ল সেই সিনেমা। শুধু প্রথম সিনেমাই নয়, পরপর বেশ কয়েকটি সিনেমা ফ্লপ করল। কিন্তু যে রাস্তায় এসে পড়েছেন, সেখানে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করার জেদ চেপে গিয়েছে দিলীপ কুমারের মনে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে এল সেই বহুপ্রতীক্ষিত সাফল্য। ‘জগনু’ সিনেমা থেকেই দিলীপ কুমার জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন দর্শকদের কাছে। এর পরের বছরই মুক্তি পেল ‘শহিদ’ এবং ‘মেলা’। তারপর একে একে ‘দাগ’, ‘আজাদ’, ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘গঙ্গাযমুনা’… তালিকাটা দীর্ঘ। ৫ দশকের অভিনয় জীবনে মোট ৬৫টি সিনেমা করেছেন তিনি। আর এর মধ্যে ১৯টি ছবির জন্য পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

বাণিজ্যিকভাবে দেখলে, একটানা ১০ বছর সবচেয়ে বেশি ব্যবসার রেকর্ড ‘মুঘল-এ-আজম’ সিনেমাটির। সম্ভবত এটিই দিলীপ কুমারের অভিনয়জীবনে সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন। জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে, বেড়েছে তাঁকে নিয়ে চর্চাও। বলিউডের দুই জনপ্রিয় নায়িকা মধুবালা এবং বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে তাঁর ব্যর্থ প্রেমের কাহিনিও ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। অবশ্য এইসমস্ত কাহিনির মধ্যে সত্যতা কতটুকু, তা জানেন না কেউই। কিন্তু এই কাহিনি থেকেই পেয়ে গেলেন আরও একটি নাম। ট্র্যাজেডি কিং। ১৯৬৬ সালে দিলীপ কুমার তাঁর চেয়ে ২২ বছরের ছোট নায়িকা সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন।

শুধুই প্রতিভাবান অভিনেতা নন, সেইসঙ্গে তাঁর অনুশীলনও ছিল অনবদ্য। ছোট থেকেই গান গাইতে ভালোবাসতেন তিনি। পরবর্তীকালে সিনেমায় মহম্মদ রফির গলায় তাঁর গানের দৃশ্যগুলি প্রতিটিই কিংবদন্তি হয়ে থেকে গিয়েছে। শুধু গানই নয়, ক্যামেরার সামনে প্রতিটি ভূমিকার জন্য অনুশীলন নিতেন গভীরভাবে। ‘কোহিনূর’ সিনেমার একটি গানের দৃশ্যের জন্য সেতার বাজানোও শিখেছিলেন তিনি।

সারা জীবনে অসংখ্য সম্মান পেয়েছেন দিলীপ কুমার। ১৯৯১ সালে পেয়েছেন পদ্মভূষণ। ১৯৯৪ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০১৫ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। আজ সেই সমস্ত কীর্তিকে পিছনে ফেলে চলে গেলেন দিলীপ কুমার। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। আজ সকালে মুম্বাইয়ের হিন্দুজা হাসপাতালে শেষ হয় ট্র্যাজেডি কিং-এর লড়াই। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ ভারত-পাকিস্তান দুই দেশই।

Powered by Froala Editor

More From Author See More