ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপনেই কাননদেবীর নজর কেড়েছিলেন তরুণ, খুলেছিল ভাগ্য

মেট্রো সিনেমার গলিতে তখন ঢেলে বিক্রি হয় সাইক্লোস্টাইল স্ক্রিপ্ট। সিনেমার স্ক্রিপ্ট। গোল্ডউইন মেয়রের যেসব ছবি দেখানো হত মেট্রোতে, এই সব স্ক্রিপ্ট তাদেরই। সিনেমার স্ক্রিনিং-এর সময় সেন্সর করার জন্যই আলাদা করে এই স্ক্রিপ্ট পাঠানো হত মেট্রোতে। স্ক্রিনিং হয়ে যাওয়ার পরই সেগুলো নাম লেখাত বাতিলের খাতায়। অবহেলিত স্ক্রিপ্টরা জায়গা করে নিত ফুটপাথে। চার আনা প্রতি সের দরে বিক্রি হত সেসব স্ক্রিপ্ট। ক্রেতদের অধিকাংশই এইসব স্ক্রিপ্ট কিনতেন ঘর সাজানোর জন্য। এমন দু’-একটা স্ক্রিপ্ট বাড়িতে রাখলে আভিজাত্য ও সংস্কৃতি-মনস্কতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৈকি। পঞ্চাশের দশকে মেট্রোর এই গলিতেই হাজির হতেন এক তরুণ কলেজ পড়ুয়াও। আর পাঁচজন ক্রেতাদের থেকে খানিক ভিন্নই ছিলেন তিনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হাতড়াতেন সেসব স্ক্রিপ্ট। তারপর সযত্নে ব্যাগে ভরতেন পছন্দসই সাইক্লোস্টাইল। না, নিছক ঘর সাজানোর জন্য নয়, পরিচালকের ভাবনার সঙ্গে তাঁর কল্পনার দূরত্ব ঠিক কতটা— সেটা পরখ করাই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। 

তরুণ মজুমদার (Tarun Majumder)। গত ২২ বছর ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক। অবশেষে ইতি পড়ল সেই লড়াইয়ে। ব্যর্থ হল চিকিৎসকদের সকল প্রচেষ্টা। ৯১ বছর বয়সে অন্য দুনিয়ায় ‘পলাতক’ হলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা পরিচালক। 

১৯৪৫ সাল। দেশভাগ হতে তখনও বছর দুয়েক বাকি। তবে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে বাংলার পরিস্থিতি। সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে উঠছে অখণ্ড বঙ্গদেশে। তখন মাত্র ১৪ বছর বয়স তাঁর। ওপার বাংলার বগুড়ার ভিটেমাটি ছেড়ে সপরিবারে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। ভর্তি হন সেন্ট পলস কলেজে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়ে ওঠে কলেজ হোস্টেল। পরবর্তীতে স্কটিশ চার্চ থেকে রসায়নে স্নাতকতা।

আদ্যন্ত সায়েন্সের ছাত্র থেকে ফিল্মমেকার— তরুণ মজুমদারের এই যাত্রা কোনো রূপকথার চেয়ে কম নয়। সিনেমার সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল হোস্টেল জীবন থেকেই। মেট্রোর গলিতে মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের সঙ্গে হানা দিতেন তরুণ। সেলুলয়েড পর্দায় সিনেমা শুরু হলেই ডুবে দিতেন কল্পনার জগতে। চরিত্র-প্রেক্ষাপট একই থাকত, শুধু মনে মনে তাদের নিয়ে অন্য এক গল্প বুনতেন তরুণ। তারপর একদিন খোঁজ মিলল, মেট্রোর পিছনের ফুটপাথে নাকি বিক্রি হয় এইসব সিনেমার সাইক্লোস্টাইল স্ক্রিপ্ট। এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা যায় নাকি? জঞ্জাল ঘেঁটে অমূল্যরতন খোঁজা প্রায় নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর। বলতে গেলে, মেট্রোর এই গলিই ছিল তাঁর চলচ্চিত্র জগৎ অভিযানের প্রথম স্টপেজ। 

আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমায় ‘থিম সং’ এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

তবে ক্যামেরার পিছনে দাঁড়ানোর অধিকার আদায়ের পথ খুব কিছু মসৃণ ছিল না কোনোদিনই। টলিপাড়া তখন আন্দোলিত নবজাগরণের জোয়ারে। শুরু হয়ে গেছে ‘উত্তম’ ও ‘সত্য’-যুগ। বড়োমামার সুপারিশে রুপশ্রী স্টুডিও-তে বিনা মাইনের কাজ পেয়ে যান তরুণ। পরিচালক হওয়ার স্বপ্নকে মাটিতে মিশিয়ে শুরু করেন ক্যামেরার কাজ শেখা। খুব বেশিদিন সুযোগ মিলল না সেটারও। তাঁকে বদলি করে দেওয়া হল বিজ্ঞাপন দপ্তরে। তবে কে জানত, অলৌকিক কাণ্ড ঘটে যাবে এতেই!

আরও পড়ুন
বাংলা সিনেমার নবজাগরণ ও আবহমান ঋতু

শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের ছবি ‘পথিক’-এর কাজ চলছে তখন। সেই ছবির বিজ্ঞাপন গড়ার দায়িত্ব পড়ল তরুণের কাঁধে। স্বকীয় ভঙ্গিতেই এক ব্যতিক্রমী বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন তরুণ। বাংলার দর্শকদের তো বটেই, নজর কেড়েছিলেন পরিচালক দেবকীকুমার এবং প্রযোজক কাননদেবীর। মোড় ঘুরে যায় জীবনের। কাজ জুটে যায় কাননদেবীর প্রযোজনা সংস্থায়। দিলীপ-শচিনের সঙ্গে আলাপ তখনই। ‘যাত্রিক’-এর জন্মও এই প্রযোজনা সংস্থাতেই। 

আরও পড়ুন
বিশু-শিবু, ভিক্টর আর কেষ্টদা: সিনেমার অন্য মুখ

প্রথম ছবি ‘চাওয়া-পাওয়া’। উত্তম-সুচিত্রাকে অভিনেতা হিসাবে পাওয়া ছিল একপ্রকার স্বপ্নের মতোই। তারপর দ্বিতীয় ছবি ‘কাচের স্বর্গ’-তে জাতীয় পুরস্কার। সহকর্মী দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে নায়কের ভূমিকায় নামিয়েই তৈরি করেছিলেন এক ভিন্ন জগৎ। নায়ক মানেই যেন গ্ল্যামার-দুনিয়া, এই প্রচলিত ধারণাকেই ভেঙে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন অনায়াসে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ‘পলাতক’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় ছবি উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। আর এই গোটা যাত্রাপথেই তাঁর পাথেয় ছিল সারল্য। যদিও শেষ বয়সে এসে যেন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল তাঁর নিজেকে ভাঙার অভ্যাস। 

২০১৮ সালেই শেষ ছবি। তারপর এক ভিন্ন ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ক্যামেরার বদলে হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন কলমকে। টলিপাড়ার গলি-ঘুঁজির গল্প তুলে এনেছিলেন দু’মলাটে। তাঁর সেই স্মৃতিকথন, ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ কোনো ডকুর থেকেও কম নয় কোনো অংশেই। 

চলতি দশকের শুরু থেকেই ক্রমশ শূন্যতার দিকে ঢলছে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ। একে একে অন্যজগতে পাড়ি দিচ্ছেন ছাতার মতো ব্যক্তিত্বরা। এবার সেই তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে সেই শূন্যতা আরও খানিক বাড়ল বৈক্য। আরও খানিক তারুণ্য হারাল বাংলা ছবি…

তথ্যসূত্রঃ

১. মুখোমুখি তরুণ মজুমদার…, সাক্ষাৎকার, কালি ও কলম
২. উত্তমের ‘হরিবোল’, মৌসুমিকে পাঁজাকোলা! অজস্র হিরেমানিকের সন্ধান দিয়েছেন তরুণ মজুমদার, অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩. Tarun Majumdar’s docu-feature on unorganized labours, Times Of India
৪. উইকিপিডিয়া

Powered by Froala Editor

More From Author See More