কলকাতায় ছোটো সিনেমার আসরে সেরা সৌম্যদীপের 'এলএসসি'

“এলএসডি যেমন এক মারাত্মক ড্রাগ, সামাজিক মাধ্যমও আজ তেমনই ভয়ঙ্কর ড্রাগে পরিণত হয়েছে।” বলছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক সৌম্যদীপ ঘোষ চৌধুরী। প্রসঙ্গ, তাঁর সাম্প্রতিকতম সিনেমা ‘এলএসসি’ (LSC)। সামাজিক মাধ্যমে বহুল পরিচিত তিনটি শব্দ – লাইক, শেয়ার এবং কমেন্ট। আর এই তিন শব্দের পিছনে ছুটতে ছুটতেই মানুষ কখন নিজের বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলছেন, তাই তুলে ধরেছেন সৌম্যদীপ। নামের সঙ্গেই তাই মিলিয়ে দিয়েছেন এলএসডি ড্রাগটিকে। সম্প্রতি কলকাতা শহরেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আমেরিকা প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে আয়োজিত ‘গোল্ডেন মিরর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ (Golden Mirror Film Festival)। আর সেখানে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা (Best Short Film) হিসাবে স্বীকৃতি পেল সৌম্যদীপের ‘এলএসসি’।

২৪ ডিসেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর তিনদিন ধরে চলেছে ‘গোল্ডেন মিরর ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। সিনেপ্রেমী প্রবাসী বাঙালিদের এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, চলচ্চিত্র পরিচালক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় এবং দেশের নানা প্রান্তের আরও অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষ। আর অবশ্যই সঙ্গে ছিল ১৫টি দেশের নানা ভাষা ও সংস্কৃতির ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য সিনেমা। সম্পূর্ণ ঘরোয়া মেজাজেই চলছিল সিনেমা দেখা এবং তা নিয়ে আলোচনা।

অনুষ্ঠানের শেষদিন ছিল পুরস্কার ঘোষণার পালা। আর সেখানেই পুরস্কৃত হল সৌম্যদীপের সিনেমাটি। মাত্র ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটির মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এক কঠোর বাস্তবকে। অবশ্য সিনেমার মূল্যায়ন তো তার দৈর্ঘ্যের নিরিখে করা সম্ভব নয়। অন্তত তেমনটাই মনে করেন সৌম্যদীপ। গৌতম ঘোষের কথার সূত্র ধরে তিনি বলেন, “সিনেমার গ্ল্যামার গায়ে জড়িয়ে নিতে যে উৎসাহ দেখা যায়, একটা সিনেমা নির্মাণের পিছনে সেই পরিশ্রমটা ধরা পড়ে না অনেক ক্ষেত্রেই। আমি তাই গ্ল্যামারের জগত থেকে একটু দূরে থেকে নিজের মতো সিনেমাটাই বানাতে চাই।” তাঁর এই সিনেমাতেও ধরা পড়েছে সেই গ্ল্যামারের আকর্ষণের কাহিনিই। তবে সেটা সিনেমার জগতের গ্ল্যামার নয়।

সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তার দৌড়ে খানিক পিছিয়ে পড়া এক যুবকের গল্প এলএসসি। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে যে ঠিক করে, লাইভে এসে সবার সামনে সে আত্মহত্যা করবে। তার এই কাজ জনপ্রিয়তা এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা দেখার মতো অবস্থায় আর থাকে না সে। এই যুবকটির চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রশান্ত সূত্রধর। বলা যায় তিনিই সিনেমার একমাত্র মূল অভিনেতা। প্রশান্তর কথায়, “সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা নিয়ে সিনেমাটি তৈরি হলেও এটার পেপারওয়ার্ক করতে গিয়ে আরও অনেক বিষয় ভাবিয়েছে আমাকে।” বলছিলেন ছোটবেলায় গ্রামের সমষ্টিবদ্ধ জীবনে যখন প্রথম টেলিভিশন এসে ঢুকে পড়ে, সেই সময়ের কথাও। তারপর এক এক করে এসেছে ইন্টারনেট, এবং নানা সামাজিক মাধ্যম। নামে সামাজিক মাধ্যম হলেও আসলে সমাজবদ্ধ জীবন থেকে আমাদের ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে এগুলি। প্রশান্ত বলছিলেন, “ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিও সেই একই কাজ করছে। আমরা এখন একই ঘরের মধ্যে থাকলেও দুজন মোবাইল ফোনে আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান দেখতে থাকি।”

সমাজ থেকে সরে যেতে যেতেই এসে পড়ে হতাশা। আর তাকে আরও উস্কে দেয় একজন শিল্পীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার নেশা। প্রশান্ত বলছিলেন, “আমরা জানতাম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার তাগিদ থেকেই শিল্পী তাঁর শিল্পের উন্নতি ঘটান। অথচ এখন তো দেখতেই পাই, কেউ খারাপ গান গাইলে, কুৎসিত অভিনয় করলেই তাঁকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়।” সেই জনপ্রিয়তার নেশায় প্রকৃত শিল্পীরাও আরও খারাপ গান করতে, আরও কুৎসিত অভিনয় করতে শুরু করেন। হারিয়ে ফেলেন শিল্পীর সত্তাটাই। বাস্তব জীবনে মৃত্যু না হলেও, সেটা তো শিল্পী জীবনের মৃত্যুই। সেটা তো একজন শিল্পীর আত্মহত্যা। যে আত্মহত্যার কারণ বর্তমান সময়ের এক মারাত্মক ড্রাগ এলএসসি।

Powered by Froala Editor