শৈশবের খাতায় আঁকা গঙ্গার ঘাটের ছবি, ম্যাক্স মুলারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ‘বহু শতাব্দীর’

সময়টা উনিশ শতকের তিনের দশক। ঘটনাস্থল জার্মানির লিপজিগ শহর। বছর দশেকের এক বালকের সঙ্গে তখন প্রথম পরিচয় ঘটল ভারতবর্ষের। সরাসরি নয়, খাতার মলাটের একটি ছবি দেখে। কাশীর গঙ্গার ঘাটে স্নানের চিত্র। বড্ড অস্পষ্ট সে ছবি, তবু স্বপ্নাবিষ্টের মতো বসে রইলেন খাতার দিকে তাকিয়ে। এর আগে অবশ্য লোকের মুখে শুনেছেন বিচিত্র সেই দেশের কথা। মনে হত, এ যেন ‘স্বপ্নরাজ্যের সুন্দরী’। অথচ কত গুজব রয়েছে দেশটিকে ঘিরে। সেখানের সবাই নাকি ‘অসভ্য’, বিধবাদের জ্বলন্ত চিতায় সমর্পণ করাই নাকি একমাত্র সংস্কৃতি। জগন্নাথের রথের তলায় নিজেকে নিক্ষেপ করে শরীর রক্তাক্ত করে মানুষ। কই, খাতার ছবি দেখে তো সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না? প্রত্যেকটি পুরুষই সেখানে লম্বা, সুশ্রী। পিছনে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ মন্দিরের অপূর্ব কারুকার্য। দ্বিধাগ্রস্ত মুগ্ধতায় কখন যে সময় কেটে গেল, টেরই পেলেন না। শেষে হুঁশ ফিরল শিক্ষক কান ঝাঁকিয়ে শাস্তি দেওয়ায়।

সেদিনের সেই বালকের নাম ফ্রেডরিখ ম্যাক্স মুলার (Max Muller)। পরবর্তীকালে যিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রবিশারদ হিসেবে। শুধু দার্শনিক বা ধর্মতত্ত্ববিদ বললে তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। জন্ম ১৮২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর, তৎকালীন ইউরোপের প্রুশিয়া প্রদেশের ডেসাউ শহর। পিতা উইলহেম মুলার ছিলেন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। ফ্রেডরিখের মধ্যেও ছিল সেই সকল গুণ। কিন্তু অল্প বয়সে পিতার মৃত্যুর পর কিছুটা বাধ্য হয়েই সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করতে হয়। ১৮৪১ সালে লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রাচীন ইউরোপীয় ভাষা-সাহিত্য চর্চার জন্য। গ্রিক, ল্যাটিন ভাষা অধ্যয়নের পাশাপাশি প্রথম নজরে আসে সংস্কৃতের মাহাত্ম্য। তখন সদ্য লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। ভারতীয় সাহিত্য বিষয়ে ক্লাস নেন বিখ্যাত পণ্ডিত ব্রকহস সাহেব। বাকি সমস্ত ভাষার আকর্ষণ ক্ষীণ হতে হতে ম্যাক্স মুলার মেতে উঠলেন সংস্কৃত নিয়ে। নল-দময়ন্তী, শকুন্তলার কাহিনি পড়ে সেই ছোটোবেলার স্বপ্নরাজ্যের প্রত্যক্ষ স্বাদ পেলেন। ঋগ্বেদের কিছু অংশও এখানে পড়েছিলেন তিনি। 

এরপর চলে আসেন জার্মানির রাজধানী বার্লিনে। ফ্রাঞ্জ বোপ এবং ফ্রেডরিক শিলিংয়ের কাছে অতি যত্ন নিয়ে সংস্কৃত ভাষার দীর্ঘ চর্চা করেন। সেই সময়েই হাত দেন উপনিষদ অনুবাদের কাজে। পাশাপাশি বোপের তত্ত্বাবধানে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন ‘হিতোপদেশ’-এর কাহিনিগুলি। এরপর কিছুদিন ফ্রান্সে থেকে সংস্কৃত পুঁথির খোঁজে চলে আসেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। তখনও উপনিষদের বক্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে। ১৮৪৯ সালে সায়নাচার্য্যের ভাষ্য-সহ ম্যাক্স মুলারের সম্পাদনায় ঋগ্বেদের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। আর দীর্ঘ গবেষণার পর ষষ্ঠ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে। ইতিমধ্যে নিযুক্ত হয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে। প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রধানতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। আমৃত্যু এখানেই গবেষণা করেছিলেন তিনি। ১৮৭৫ সালে ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলির নির্বাচিত অংশ ‘সেক্রেড বুক অফ দ্য ইস্ট’ নামে অনুবাদের বিরাট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জীবৎকালে অধিকাংশ খণ্ডের কাজই শেষ করে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর ‘বেদান্ত দর্শন’ এবং ‘সিক্স সিস্টেমস অফ ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’ গ্রন্থ দুটি ভারতীয় শাস্ত্র ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিরাট পাণ্ডিত্যের উদাহরণ।

সেই সময়ে তাঁর কানে আসে এক ভারতীয় মনীষীর নাম। তিনি দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। মুখোমুখি কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়নি দুজনের। কিন্তু ম্যাক্স মুলার ইংল্যান্ডে বসেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন রামকৃষ্ণ সম্পর্কে। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দের দ্বিতীয় ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় দেখা হয়েছিল ম্যাক্স মুলারের সঙ্গে। ১৮৯৮ সালে রামকৃষ্ণের জীবনী নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও প্রকাশ করেন তিনি।

আরও পড়ুন
আকবরের হাত ধরেই জন্ম বাংলা ক্যালেন্ডারের, হয়ে উঠল বাংলা সংস্কৃতির অঙ্গ

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ম্যাক্স মুলার কখনই স্বচক্ষে ভারতদর্শন করতে পারেননি। প্যারিসে থাকাকালীন প্রবল ইচ্ছে ছিল ভারতে আসার। তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অর্থ। পরে যতবারই পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, ততবারই কোনো না কোনো সমস্যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। না, কোনো আক্ষেপ নেই তাতে। ইউরোপে বসেই ভারতবর্ষ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পেরেছিলেন এদেশের বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আলাপের সূত্রে। কিন্তু তাতে তো সম্পূর্ণ ভারতকে চেনা সম্ভব নয়। অস্বীকার করেননি তিনি। আবার এটাও ঠিক, যে ভারতকে তিনি চিনতে চেয়েছিলেন, তা সামান্য কয়েকদিনের ‘ভ্রমণ’-এ সম্ভব নয়। তখন ইউরোপ থেকে জলপথে এদেশে আসতে লেগে যেত কয়েক মাস। এখানের মানুষ, ভাষা, জীবনযাত্রা, লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণার জন্য অন্তত বছর দুয়েক সময় তো ব্যয় হতই। শুধু কলকাতা বা বোম্বাই ঘুরে যে জ্ঞান তিনি পেতে পারতেন, তা অনায়াসে ইংল্যান্ডের যে কোনো গ্রন্থাগারেই পাওয়া সম্ভব। 

আরও পড়ুন
তিন-তিনবার নেপাল রাজদরবারে হাজির নাছোড় হরপ্রসাদ, খুঁজে পেলেন চর্যাপদ

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি বলেছিলেন, “আমার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তো উপর থেকে নয়, তাহা বহু শতাব্দীর ভিতর দিয়ে।” ছোটোবেলার খাতার পাতায় দেখা ছবি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার ডানা মেলে উড়ে গেছে বহু দূরে। তারই সন্ধানে রত ছিলেন সারা জীবন। নাই-বা হল ভারতদর্শন। এদেশের ভাষা আর সংস্কৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন আত্মীকরণ করেছিলেন তিনি। বিদেশি হয়েও যে তিনি ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ মন্ত্রের পূজারি। 

Powered by Froala Editor

Latest News See More