তিন-তিনবার নেপাল রাজদরবারে হাজির নাছোড় হরপ্রসাদ, খুঁজে পেলেন চর্যাপদ

উনিশ শতকের শেষের দিক। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে পুঁথি নিয়ে কাজ করছেন রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র। বাংলা জুড়ে যে হাজার হাজার সাহিত্য লুকিয়ে আছে, পর্দা সরিয়ে সেসব খুঁজে আনার জন্য সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি। সেই পরিশ্রমের ফল হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ বেঙ্গল’। এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে সেখানে সংকলিত বৌদ্ধ পুরাণগুলির অনুবাদ করছিলেন সংস্কৃত কলেজের এক অধ্যাপক। তিনি বিদ্বান, নানা বিষয় অশেষ জ্ঞান এবং কৌতূহল। যতই অনুবাদ করতে থাকেন, ততই ঢুকে পড়েন পুঁথির রহস্যময় জগতে। যা দেখছেন, যা পড়ছেন সেটাই কি সব? নাকি পেছনের রাস্তাটা আরও লম্বা, আরও রোমাঞ্চকর? সেদিন থেকেই যাত্রা শুরু হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। যাত্রা শুরু এক আবিষ্কারের; যার মূলে আছে একটাই নাম— চর্যাপদ…

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর যোগ্যতা নিয়ে কারোরই কোনো সন্দেহ ছিল না। বাংলা, সংস্কৃত, দর্শনে তুখোড়। সংস্কৃতে সাম্মানিক ডিগ্রি অর্জন করার পর ‘ভট্টাচার্য’ বদলে যায় ‘শাস্ত্রী’তে। সেইসঙ্গে ছিল অধ্যাপনা এবং বেঙ্গল লাইব্রেরির গ্রন্থাকারিকের দায়িত্ব। ততদিনে বাংলা এবং ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য, সাহিত্য এবং নিদর্শনগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এশিয়াটিক সোসাইটি। এমন একটি কাজে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর যুক্ত হয়ে যাওয়াটা যেন নিয়তি ছিল। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সঙ্গেই কাজ করতে লাগলেন তিনি। আর সেইসময়ই নজর পড়ল প্রাচীন বাংলার পুঁথির দিকে। 

বই প্রকাশ এবং ছাপাখানা আসার আগে পুঁথিই ছিল সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কয়েকশো বছর আগের প্রাচীন ভারতে যে ধারা বয়ে গিয়েছিল, পুঁথিগুলো সেই সবেরই সাক্ষ্য বহন করছে। সেখানে বাংলা ভাষা কেমন করে উঠে আসছে, তার বিবর্তন কীভাবে হয়েছে সেসব নিয়েই উৎসাহী হয়ে পড়লেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তখনও বাংলা ভাষাকে খুব বেশি পুরনো বলে মানা হত না। সেরকম তথ্য প্রমাণও ছিল না। রাজেন্দ্রলালও বাংলার আদি পুঁথি ও সাহিত্য নিয়ে নানা খোঁজ চালাচ্ছিলেন। তাঁর ধারণা, বাংলা থেকে যখন ক্রমশ মুছে যাচ্ছে বৌদ্ধধর্ম; তখনই বেশ কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষুক ও পদকর্তা প্রাণের ভয়ে নেপাল, তিব্বতের মতো জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে চলে গিয়েছিল তখনকার পুঁথিও। কাজেই যদি নিদর্শন পাওয়া যায়, তাহলে ওসব জায়গাতেই পাওয়া যাবে। 

নিজের জীবদ্দশায় নেপালেও গিয়েছিলেন রাজেন্দ্রলাল। কিন্তু ১৮৯১ সালে তাঁর মৃত্যু সেই কাজে সাময়িক বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে গবেষণা শুরু হতে দেরি হয়নি। এশিয়াটিক সোসাইটির পুঁথিসংগ্রহের কাজ দেখার দায়িত্বে এলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। প্রায় একই সময় একটি ঘটনা তাঁকে আরও ভাবাতে বাধ্য করল। খবর পেলেন, একদল ইউরোপীয় গবেষক নেপাল আর তিব্বত ঘুরে প্রাচীন পুঁথির একটি বিশাল ভাণ্ডার আবিষ্কার করেন। এই খবরই হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে। ঘরে বসে কাজ নয়; সরাসরি অকুস্থলে গিয়ে গবেষণা চালাতে হবে। প্রস্তুত হলেন হরপ্রসাদ। এবার গন্তব্য নেপাল… 

১৮৯৭ সাল। প্রথমবার নেপালের মাটিতে পা রাখলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ততদিনে পুঁথি সংক্রান্ত গবেষণাও কিছুটা এগিয়েছে। নেপালে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন কাঠমান্ডুর রাজদরবারের গ্রন্থাগারে। বিশাল তার ভাণ্ডার, বিপুল আয়োজন। হাতে যেন স্বর্গ পেলেন হরপ্রসাদ। সেই ঘরেই যেন গন্ধ পেলেন বাংলার প্রাচীন সময়ের। তালপাতার পুঁথিগুলো যে সাক্ষাৎ ইতিহাস! পরের বছর, ১৮৯৮ সালে আবার গেলেন নেপালে। রাজদরবারের গ্রন্থাগারে আরও গভীর ডুব দিলেন তিনি। উঠে এল দুটি পুঁথি- ‘সুভাষিত সংগ্রহ’ ও ‘দোঁহাকোষ পঞ্জিকা’। পণ্ডিতমহলে ছোটখাটো আলোড়ন পড়ে গেল। এই আবিষ্কারই বিশাল ব্যাপার। কিন্তু হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। আরও যেন কিছু আছে ওখানে… 

দশ বছর পরের ঘটনা। ১৯০৭ সালে আবার নেপালের রাজদরবারে উপস্থিত হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। আবার ডুব দিলেন গ্রন্থাগারে। হঠাৎই খুঁজে পান একটি তালপাতার পুঁথি। বৈষ্ণব কীর্তনের মতো বেশ কিছু পদ লেখা আছে সেখানে। পুঁথির নাম- ‘চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর চোখ চকচক করে উঠল। এটাই কি তাহলে সেই অভীষ্ট বস্তু? বাংলার প্রাচীনতম নিদর্শন? 

আরও পড়ুন
যোগ্যতা সত্ত্বেও সুযোগ পাননি টেস্ট দলে, বাঙালি-বঞ্চনার শিকার ছিলেন গোপাল বসু?

১৯১৬ সাল। বঙ্গদেশে প্রকাশিত হল ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধগান ও দোঁহা’। রচয়িতা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। দীর্ঘদিনের নেপাল যাত্রার ফলাফল প্রকাশিত হল এই বইতে। বাংলার সাহিত্য জগত ও গবেষকরা ধাঁধিয়ে গেলেন। সামনে এল ‘চর্যাপদ’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নিরলস গবেষণা প্রমাণ করেছে, ঐ বৌদ্ধ পদগুলি আসলে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। প্রশংসার ঢেউ উঠল বঙ্গসমাজে। সেইসঙ্গে হাজির হল বিতর্কও। যে তালপাতার পুঁথিটি পাওয়া গিয়েছিল, তার বেশ কিছু পাতা নষ্ট হয়েছিল। তিনটে সম্পূর্ণ চর্যা এবং একটির অর্ধেক পাওয়া যায়নি আর। মোট ২৪ জন ‘পাদ’ বা পদকর্তার নাম উঠে এল। লুইপাদ, ভুসুকপাদ, কুক্কুরীপাদ প্রমুখদের সঙ্গে পরিচিত হল বাংলা। আজও যাঁরা হারিয়ে যাননি ইতিহাস থেকে। 

কিন্তু ভাষাটি কি সত্যিই বাংলা? একটা দীর্ঘ সময় ধরে এই একটি প্রশ্ন নিয়েই বিতর্ক চলল। প্রশ্ন থাকল চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে। উড়িয়া, হিন্দি ভাষার পণ্ডিতরাও নিজেদের দাবি নিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলার কাছে এসেই থামে চর্যাপদের ঘোড়া। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তো বটেই; পরবর্তীতে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহের মতো বিদ্বান মানুষরাও প্রমাণ করে দিয়েছিলেন বাংলার প্রাচীনত্বকে। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে রচিত একটি ছোট্ট পুঁথি বদলে দিল বাংলা ভাষার ইতিহাস। আর নেপথ্যে থাকা মানুষটি? পরবর্তীকালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেখানো পথে চর্যাপদ নিয়ে আরও গবেষণা হয়েছে। আরও নতুন নতুন পদ পাওয়া গেছে। এই গোটা কর্মকাণ্ডের শুরুর রাস্তাটা যিনি দেখিয়েছিলেন, তাঁকে তো বাংলা ভুলে যেতে পারে না। বাংলা ভাষা ভুলে যেতে পারে না। 

তথ্যসূত্র—
১) ‘চর্যাপদ: ফিরে তাকানো’, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, প্রথম আলো
২) ‘সাহিত্যের সূর্যাভাস’, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, প্রথম আলো
৩) ‘চর্যাপদ-গবেষণায় মাইলফলক: নতুন চর্যাপদ’, কালি ও কলম   

আরও পড়ুন
ছিলেন ৪৩টি বেশ্যালয়ের মালিক, সোনাগাছির সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম; দ্বারকানাথের অন্য ব্যবসার গল্প

Powered by Froala Editor

More From Author See More