লন্ডনে দুর্গাপুজো, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মুখে দেবীর ‘ঘরোয়া’ কাহিনি

১৯২৪ সাল। বাংলা নাটকের প্রাঙ্গণে সাজো সাজো রব। নতুন ভাবনা আর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মঞ্চে অবতরণ করতে চলেছেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। যোগেশ চৌধুরীর লেখা ‘সীতা’ নাটক মঞ্চস্থ হবে নাট্যমন্দিরে। সেই সময়ের বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকপাল ব্যক্তিরা এগিয়ে এলেন শিশিরকুমারের সাহায্যে। বাংলা থিয়েটারে প্রথমবার সঙ্গীত পরিচালনা করবেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। সঙ্গীত রচনা ও  নৃত্যপরিকল্পনায় হেমেন্দ্রকুমার রায়। দৃশ্যপটের যাবতীয় খুঁটিনাটির দায়িত্বে শিল্পী চারু রায়। পৌরাণিক নাটকের সাজসজ্জায় যাতে কোনো খুঁত না থাকে, তার দেখভালে রইলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিও যুক্ত ছিলেন এই দলে। নাট্যকাহিনির ইতিহাসগত প্রেক্ষাপটের তত্ত্বাবধান করলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (Suniti Kumar Chattopadhyay)। 

বাঙালির কাছে সুনীতিকুমারের মূল পরিচয় ভাষাতাত্ত্বিক ও ব্যাকরণবিদ হিসেবে। একই সঙ্গে কাজ করেছেন ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির রূপ-রূপান্তরের সন্ধানে। ১৮৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাওড়ার শিবপুরে তাঁর জন্ম। স্কুল-কলেজের প্রায় সব পরীক্ষাতেই অর্জন করেছিলেন প্রথম স্থান। বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হলেও, কিছুদিন পরেই চলে আসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংল্যান্ড যাত্রা এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধ্বনিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা লাভ। দু’বছরের মধ্যেই অর্জন করেন ডি.লিট। শিক্ষকতা করেন বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউরোপের ঘুরে কলকাতায় ফিরে আসার পর ‘স্যার’ আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁকে নিয়োগ করেন ‘খয়রা’ অধ্যাপক হিসেবে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’। এছাড়াও ‘বাঙ্গালা ভাষাতাত্ত্বিকের ভূমিকা’, ‘সাংস্কৃতিকী’, ‘জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য’-র মতো গ্রন্থে ছড়িয়ে আছে তাঁর পাণ্ডিত্যের নমুনা।

১৯২০ সালের অক্টোবর মাস। তিনি তখন লন্ডনে। মাঝেমধ্যে ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি, ঠাণ্ডাও পড়তে শুরু করেছে ধীরেসুস্থে। বাংলার আকাশের সঙ্গে বিস্তর তফাৎ। গবেষণার ব্যস্ততায় ভুলেই গেছিলেন অক্টোবর মানেই শারদোৎসব। লন্ডনের যে ছাত্রাবাসে থাকতেন, সেখানে তিনি একাই ভারতীয়। দুর্গা পুজোর কথা মনে করিয়ে দেওয়ারও কেউ নেই। একদিন সন্ধ্যাবেলা আগুনের হালকা আঁচে ড্রইং রুমে বসে বই পড়ছেন, তখনই ডাক পড়ল তিন-চারজন বাঙালির। প্রত্যেকেই কমবেশি পরিচিত, লন্ডনেই থাকেন তাঁরা। শুধু সহপাঠীর ভাই বলে বটুর সঙ্গেই একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা সুনীতিকুমারের। আর ঘরে ঢুকেই প্রায় চিৎকার করে উঠল বটু, “এই যে সুনীতি দা, তোমাকে বড্ড দরকার।” 

কী ব্যাপার? তিনদিন পরে তো দুর্গা পুজো। একেবারেই খেয়াল ছিল না তাঁর। কিন্তু বটু সদ্য এসেছে দেশ থেকে। তাঁর বাড়িতে বাৎসরিক পুজো হয়। ফলে এই দিনগুলিতে তাঁর মনটা একটু অস্থির হয়ে উঠছে। কেমন হয়, যদি লন্ডনের পরিচিত বাঙালিদের নিয়ে একটা দুর্গা পুজো করা যায়? এর আগে তো কখনও এখানের বাঙালিরা শারদোৎসবে মেতে ওঠেনি। পুজোটা অবশ্য প্রতীকীমাত্র, আসল উদ্দেশ্য সকলকে একত্রিত করে খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা হবে। বটু অবশ্য চায় লন্ডনের সব বাঙালিকে একত্রিত করে বিরাট ধুমধাম করতে। কিন্তু হাতে সময় কম, বাজেটেরও একটা সমস্যা রয়েছে। তিনদিন ছুটি পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল, মহাষ্টমীর দিন বটুদের হ্যাম্পস্টেডের ভাড়াবাড়িতে হবে অনুষ্ঠান। বাড়ির কর্ত্রী ভালো মানুষ, একতলার বড়ো ঘরটা পেতে অসুবিধা হল না। রান্নার দায়িত্বে কানু ও রঞ্জন। লন্ডনের সমস্ত বাঙালির বদলে অতিথির সংখ্যা বড়োজোর দশজন। তার মধ্যে দুয়েকজন অবাঙালি।

আরও পড়ুন
ফরাসি সাহিত্যচর্চায় পেয়েছিলেন সম্মান, বাঙালির কাছে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম লোকনাথ ভট্টাচার্য

অষ্টমীর দিন আলাপ হল সকলের সঙ্গে। জমে উঠল গল্প-গুজব। হঠাৎ অগ্নিকুণ্ডের মাথা থেকে ফ্রেমে বাঁধানো দেবী দুর্গার একটি ছবি বের করল বটু। সঙ্গে সেই সময়ের ভারতের পতাকা, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের ছবি এবং একটি গীতা। দেশ ছেড়ে এলেও, দেশপ্রেমকে সে সঙ্গে ঘুরছে ইংল্যান্ডে। গান-বাজনা, গল্প-গুজব বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। এবার দেবীর আরাধনা শুরু হবে। আর সুনীতিকুমার থাকতে এত বড়ো দায়িত্ব আর কার উপর দেওয়া যায়? প্রচলিত পূজাপদ্ধতি অনুসরণ করে নয়, বরং শাস্ত্র থেকে দুর্গার মাহাত্ম্য কাহিনি বর্ণনার মাধ্যমেই সম্পন্ন হবে পূজা।

আরও পড়ুন
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাঙালি ‘শিক্ষক’গোষ্ঠী ও প্রথম বাংলা হাতের লেখার শিক্ষক

সুনীতিকুমার আগেই জানতেন এরকম পরিস্থিতি আসতে পারে। তাই আগের দিন রাতে কলেজের লাইব্রেরি থেকে ঋগ্বেদের দেবীসূক্তি নকল করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। অতঃপর জুতো খুলে, ‘বাবু’ হয়ে বসে শুরু করলেন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা। বললেন, “মা দুর্গা আমাদের ঘরোয়া জীবনে আর জাতীয় জীবনে—আমাদের মনের দিকে, ভাবের দিকে, শক্তিশালী হতে, মানুষ হতে চেষ্টা করার দিকে—বিরাট ভাবসাম্রাজ্যের মহৎ সিম্বল বা প্রতীক হয়ে আমাদের চিত্তপটে বিরাজমান।” কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় জমে গেল ঘরের মধ্যে। শুধু ভারতীয়রা নয়, বিদেশি মালকিনের পরিবারও উপস্থিত হল পূজাস্থলে।

এরপর খাওয়ার পালা। নিজের বাড়ির পুজোর মতোই দায়িত্ব পালন করতে লাগল বটু। সব শেষে গান ধরল পাঁচুগোপাল, “শ্মশান ভালোবাসিস বলে মা শ্যামা”। অবাঙালি বন্ধুরাও তাঁদের সংস্কৃতির নমুনা রাখল সকলের সামনে। এভাবেই কেটে গেল অষ্টমী তিথি। নবমীতে বিশেষ কিছু ছিল না। তবে দশমী আসতেই কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনদিন আগেও জানতেন না কবে দুর্গাপুজো। আর আজ বারবার মনে চলে যাচ্ছে হ্যাম্পস্টেড স্টেশনের বাড়িটার দিকে। কাজ শেষ করে সন্ধ্যার দিকে পাড়ি জমালেন সেখানে। চকলেট দিয়ে মিষ্টিমুখ আর কোলাকুলির মাধ্যমে বিজয়া দশমী সারা হল। বাড়ি ফিরলেন দশটার সময়। লন্ডনের অন্য কয়েকজন পরিচিত বাঙালি বিজয়া করতে এসে ফিরে গেছেন ততক্ষণে। একটা চিরচেনা বেদনা নিয়েই কেটে গেল ইংল্যান্ডে প্রথম দুর্গাপুজোর দিনগুলি। শুরু হল কলকাতায় ফেরার দিন গোনার পালা। 

Powered by Froala Editor