‘কবিতা’ নয়, বইয়ের নাম ‘পদ্য সমগ্র’ করে দিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়

সাতের দশকের মাঝামাঝি। জরুরি অবস্থার সময়। দেশজুড়ে চলছে অবাধ ধরপাকড়। কেউ জানে না, কখন কার নামে জারি হবে পুলিশি হুলিয়া। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে এরকম অবস্থা। প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে নিত্যনতুন গ্রেপ্তারির খবর। চারিদিকে একটা চাপা ভয়ের বাতাবরণ। প্রকাশক বাদল বসুর অবস্থা তখন বেশ সঙ্গিন। বাতাসে গুজব, তাঁকেও নাকি এবার ধরবে পুলিশ। কোনো এক নিষিদ্ধ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তাঁর নাম। অবশ্যই মিথ্যে কথা। তবে ‘একুশে আইন’-এর দেশে কি পুলিশের সঙ্গে তর্ক চলে? কিছুটা প্রাণের ভয়েই সেবার পুজোর ছুটিতে চলে গেলেন ঝাড়গ্রামের দেশের বাড়িতে। আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে সত্যিকারের আলাপ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের (Shakti Chattopadhyay)। 

পরিচয় অবশ্য আগে থেকেই ছিল। কবিতার সূত্রে তাঁকে চেনেন সেই ছয়ের দশক থেকে। দেখাও হয়েছে বেশ কয়েকবার। পরিচয় বলতে যা বোঝায়, তা তখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। শুধু বিভিন্ন আড্ডায় শুনেছেন শক্তিকে নিয়ে অসংখ্য কিংবদন্তি। অবশেষে ১৯৭৫-এর এক গভীর রাতে ‘দেখা’ দিলেন তিনি। একা নয়, সঙ্গে পুলিশের গাড়ি। যার মধ্যে বসে আছেন খোদ মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার পাঁচুগোপাল ভট্টাচার্য। মাঝরাতে পুলিশের জিপের আলো দেখে তো বাদল বসুর প্রাণ ওষ্ঠাগত। পিছনের দরজা দিয়ে সোজা চলে গেছেন পুকুরপাড়ে। যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচা যায় পুলিশের হাত থেকে। হঠাৎ নিস্তব্ধ পাড়ায় সহসা কড়া নাড়িয়ে ডাক উঠল, “বাদ্‌লা, এই বাদ্‌লা বাড়ি আছিস?” বড্ড চেনা গলা। কলকাতায় বহু জায়গায় শুনেছেন এই কণ্ঠ। শুধু যেন ‘বাদ্‌লা’-র স্থানে থাকত ‘অবনী’। কে জানত, পুলিশের গাড়িতে বসে আছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়? 

জলে ঝাঁপ দেওয়া আর হল না। বাড়ির সামনে তখন রীতিমতো হট্টগোল। কী ব্যাপার? পুলিশ সুপার প্রাণপণে চেষ্টা করছেন শক্তিকে সামলানোর। আর তিনি চিৎকার করে যাচ্ছেন, “আঃ পাঁচুদা, তুমি জানো না, বাদ্‌লা আমার বন্ধু। অ্যাই... অ্যাই বাদলা।” তখনও পুরো ব্যাপারটা ধাতস্থ হয়নি। ‘বন্ধুত্ব’ গড়ে ওঠার আগেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন ‘বন্ধু’কে বাঁচানোর জন্য। সে নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু স্বয়ং পুলিশ সুপারকে টেনে আনার কী দরকার ছিল? ক্রমে জানা গেল পুরো গল্প। পাঁচুগোপালবাবু থাকতেন কাঁকরোঝোড়ে। এদিকে শক্তিও শুনেছেন বাদল বসুকে গ্রেপ্তারের গুজব। তাই সেই রাতেই সুপারকে ডেকে তুলে সোজা চলে এসেছেন ঝাড়গ্রামে। তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, “আরও ফূর্তি হবে, চলো বাদলার বাড়িতে।”

শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ছড়িয়ে আছে এরকম অসংখ্য গল্প। তাঁর বাউণ্ডুলেপনার গল্প, জীবনের চেনা ছককে দুমড়ে-মুচড়ে হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি। আবার শক্তি মানে মাতাল-বাঁধনহীন পরিচয়কে তুড়ে মেরে উড়িয়ে “একাকী যাবো না, অসময়ে” বলার সাহস। তাঁকে নিয়ে গল্প বলতে বসলে বোধহয় শেষ হওয়ার নয়। তখন সদ্য প্রকাশিত হয়েছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতা সমগ্র’-র কয়েকটি খণ্ড। জেদ ধরলেন শক্তিও। ‘নীরেনদার’ মতো তাঁরও খণ্ডে খণ্ডে ‘কবিতা সমগ্র’ বের করতে হবে। কাজ এগোল সেই অনুযায়ী। বই প্রায় প্রস্তুত। কিন্তু যিনি মুখে ‘কবিতা’-র বদলে ‘পদ্য’ বলেন, তাঁর বইয়ের নাম তো ‘কবিতা সমগ্র’ হতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের নাম বদলে ‘পদ্য সমগ্র’ করে দিলেন শক্তি। একেবারে শেষ মুহূর্তে সাত লাইনের একটা ভূমিকাও লিখে দিলেন নিজের বইয়ের জন্য।

আরও পড়ুন
নববর্ষের খাতায় পদ্য লিখলেন শক্তিদা, মৃত্যুর ছায়া ফুটে উঠল শ্যামলদার কলমে

এদিকে বই বেরোনো মাত্রই শুরু হল তীব্র সমালোচনা। কবিতা নিয়ে নয়, সংখ্যা নিয়ে। শক্তির ভূমিকা অনুযায়ী এই ‘সমগ্র’-এ পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। অথচ প্রকাশক বলছেন ছ’টা। কার কথা মানবে পাঠকরা? ঠিক আছে, যা হয়ে গেছে, তা আর ফেরানোর উপায় নেই। দ্বিতীয় খণ্ডের সময় সাবধান থাকতে হবে। আর স্পষ্ট নির্দেশ, শেষ মুহূর্তে কোনো ‘ভূমিকা’ গ্রহণ করা হবে না। সেই মতো কাজ হল। তারপরেও ছাড় মিলল না অভিযোগ থেকে। প্রথম খণ্ডে রয়েছে এমন অনেক কবিতা তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন দ্বিতীয় খণ্ডে। এমনকি এই খণ্ডেই একই কবিতা দু’বার করে ছাপা হয়েছে। প্রকাশক ও সম্পাদক দুজনেই পরে বুঝলেন, একই কবিতা দুটি আলাদা কাব্যগ্রন্থে ছাপিয়ে দিতেন শক্তি। আর সেখানেই যত গণ্ডগোল। 

আরও পড়ুন
শেষ বয়সে গান লিখতে চেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুরের দায়িত্ব কবীর সুমনের

এক্ষেত্রেও প্রকাশক বাদল বসু। ঠিক করলেন আগে থেকেই সাবধান হতে হবে। বেছে বেছে বাদ দেওয়া হল বেশ কিছু পুনরাবৃত্তি। এমনকি ছাপা আটকে দেখা করলেন শক্তির সঙ্গে। সব ঠিকঠাক করে ফের গেল প্রেসে। যথাসময়ে প্রকাশিত হল কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু না, মুক্তি নেই। এই বই প্রকাশের আগেই অন্য একটা বইতে চালিয়ে দিয়েছেন চারটি কবিতা। ফলে আবার ফাঁপড়ে পড়তে হল প্রকাশককে। আর এই প্রথা কিন্তু থামেনি, বারবার চলেছে। তিনি ধর্মেও থেকেছেন, জিরাফেও। যদি একটা কবিতাই দুটি বইয়ের ভাবের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে দোষ কোথায়? আর শক্তির কবিতা তো দু’বার নয়, পড়া যায় বহুবার। বহুদিন ধরে। বই বদলে গেলেও কবিতার সঙ্গে কবিতার দূরত্ব বাড়ে না। যেভাবে বাড়ে না একটা গাছ থেকে আরেকটা গাছের দূরত্ব।

ঋণস্বীকার : তাঁরই সুবাদে আমি নীলকণ্ঠ, বাদল বসু

Powered by Froala Editor

More From Author See More