জাপানি শিশুদের অনুরোধ, শুভেচ্ছাসহ ‘ইন্দিরা’কে পাঠালেন নেহরু

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন ১৪ নভেম্বর এদেশে পালিত হয় ‘শিশু দিবস’। সারা বিশ্বে অবশ্য ২০ নভেম্বর পালিত এই বিশেষ দিন। সেটিও বেশি দূরে নয়। আবার জাপানের নিজস্ব শিশু দিবস ‘কোদোমো নো হি’ পালিত হয় ৫ মে। কিন্তু জাপানের শিশুদের সঙ্গে এক অদ্ভুত বাঁধনে যুক্ত জওহরলাল নেহরু। সে দেশের শিশুদের থেকে প্রায় হাজার খানেক চিঠি পেয়েছিলেন তিনি। আর সবকটাতেই ছিল একটাই অনুরোধ, “দয়া করে একটি হাতি পাঠান।” শুধু জাপান নয়, জার্মানি থেকেও এসেছিল এরকম অনুরোধ। না, কাউকেই ফেরাননি তিনি।

১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন মধ্যলগ্নে। শত্রুপক্ষের আক্রমণের ভয় রয়েছে দুই শিবিরের মধ্যেই। সেই সময়ে টোকিও শহরের মেয়র আদেশ দেয় উয়েনো চিড়িয়াখানার তিনটি হাতিকে মেরে ফেলার। খুব অদ্ভুত তার কারণ। বোমা হামলায় যদি কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে যায় হাতিগুলি, তাহলে শহরবাসীর জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠবে। জাপানের সবচেয়ে পুরনো চিড়িয়াখানায় এই হাতিরা বসবাস করছিল সেই ১৯২৪ সাল থেকে। তার মধ্যে দুটি ছিল ভারত থেকে আমদানি করা। পুরুষটির নাম জন, আর স্ত্রী হাতিটির নাম টংকা। আরেকটি হাতি এসেছিল থাইল্যান্ড থেকে। কিন্তু কীভাবে মারা হবে এদের? বেছে নেওয়া হল সবচেয়ে নৃশংস পদ্ধতি—খেতে না দিয়ে। অতো বড়ো শরীরে বিষাক্ত সুঁচ ফোটানোর উপায় নেই। চেষ্টা করা হয়েছিল বিষাক্ত খাবার দিয়েও। কিন্তু হাতির মতো বুদ্ধিমান প্রাণী সেই ফাঁদে পা দেয়নি।

অবশেষে শুরু হল অবহেলা। ক্রমশ জীর্ণ হয়ে যেতে লাগল তাদের শরীর। চোখে কাতর আকুতি নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল জন। তারপর টংকা। সুমিদা নদীতে এরপর বয়ে গেছে অনেক জল। দুটো পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটেছে, পরাজিত হয়েছে জাপান। লোকেরা ভুলেও গেছে হাতিদের কথা। শুধু ভুলতে পারেনি জাপানের শিশুরা। ওই বয়সেই যারা খুব কাছ থেকে দেখেছে মৃত্যুকে। দেখেছে মানুষ কীভাবে অনায়াসে ঘাতক হয়ে উঠতে পারে। ১৯৪৮ সালে সপ্তম শ্রেণির দুই জাপানি ছাত্র হাতি না দেখতে পারার ক্ষোভ জানিয়ে চিঠি পাঠায় সংসদে। ক্রমে সারা দেশ থেকেই আসতে থাকে কয়েকশো চিঠি। রং-বেরংয়ের কাগজে কাঁচা হাতের লেখায় ভরা চিঠিগুলি যেন শুধু হাতির জন্য আবেদন নয়, আসলে মৃত্যু-উপত্যকায় দাঁড়িয়ে নবপ্রজন্মের কাছে নতুন আশার মতো। মজার বিষয় হচ্ছে, এর অধিকাংশই কিন্তু সরাসরি টোকিও সরকারকে লেখা নয়। লেখা ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে। তাঁর কাছে হাতি পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছে জাপানের শিশুরা।

সেই সময়ে জাপানে উপস্থিত ছিলেন একজন বাঙালি। নাম হিমাংশু নিয়োগী। ব্যবসার কারণে প্রায়ই যাতায়াত ছিল সেখানে, দুদেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। তিনিই হয়ে উঠলেন সংযোগরক্ষাকারী। ৮১৫টি চিঠি নিয়ে এসে তিনি জমা করেন নেহরুর দপ্তরে। কী লেখা ছিল সেগুলিতে? পড়ে দেখা যাক দুয়েকটা, “টোকিওর চিড়িয়াখানায় আমরা শুধু শূকর আর পাখি দেখতে পাই। আমাদের আর ভালো লাগে না এগুলো দেখতে। জাপানের সব বাচ্চাদেরই বহুদিনের স্বপ্ন যে তারা একটা বিরাট বড়ো হাতি দেখবে... আপনি কি বুঝতে পারছেন, আমরা কত করে চাইছি একটা হাতি দেখতে?” প্রেরিকার নাম সুমিকো কানাৎসু, নেগিশি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী। মাসানোরি ইয়ামাতো নামের আরেক ছাত্রী লিখেছে, “হাতিরা আজও আমাদের স্বপ্নে বেঁচে রয়েছে।”

আরও পড়ুন
হাতিদের জন্য অনাথালয়, বিশ্বে প্রথম

চিঠিগুলি পেয়ে খুব একটা দেরি করেননি নেহরু। তড়িঘড়ি জাপানে পাঠিয়ে দেন ইন্দিরাকে। না, তাঁর মেয়ে ইন্দিরা নয়। তবে, হাতিটির নাম রেখেছিলেন মেয়ের নামেই। মহীশূর থেকে আনা হাতিটি ১৯৪৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মহাসমারোহে এসে পড়ে টোকিওতে। উয়েনোকে ঘিরে সেদিন যেন উৎসবের পরিবেশ। হাজার হাজার মানুষ এসেছে ইন্দিরাকে দেখতে। সঙ্গে নেহরুর একটি চিঠি, “আমি বিশ্বাস করি জাপান আর ভারতের শিশুরা একদিন বড়ো হয়ে শুধু তাদের দেশই নয়, সারা এশিয়া ও বিশ্বশান্তি রক্ষা করবে এবং পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। ভারতের শিশুদের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসার বার্তাবাহক ইন্দিরাকে তাই আদর-যত্নে রেখো।”

আরও পড়ুন
’৬২-র যুদ্ধে নাজেহাল ভারতের পাশে পাকিস্তান, সুদূর ইরান থেকে চিঠি এল নেহরুর কাছে

তবে একটা ছোট্ট সমস্যা ছিল। ইন্দিরা তখন শুধুমাত্র কন্নড় ভাষার নির্দেশ বুঝতে পারত। তাই দুই জাপানি মাহুত ভারতে এসে শিখে যান কন্নড় ভাষা। এরপর ১৯৫৭ সালে নেহরু ও তাঁর কন্যা ইন্দিরা জাপানভ্রমণ কালে দেখে আসেন ‘ইন্দিরা’কে। জাপানিরা কথা রেখেছিল। আমৃত্যু দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বের চিহ্ন বহন করেছিল ইন্দিরা। তবে জাপানের ঘটনাই শেষ নয়। এরপর একই অনুরোধ আসে বার্লিন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতিতে তাদের গোটা চিড়িয়াখানাটাই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে সেখানকার শিশুদের থেকেও হাতি দেখতে চেয়ে এল কয়েকশো চিঠি। ১৯৫১-র জুন মাসে তিন মাসের স্ত্রী হাতি ‘শান্তি’কে পাঠানো হয় সেখানে। এর দুবছর পরে কানাডা থেকেও আসে একই অনুরোধ। ১৯৫৫ সালে গ্র্যানবি চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয় ‘অম্বিকা’ নামের হাতিকে। ভাগ্যিস, এরপর আর কোনো চিঠি আসেনি। নাহলে তো সৌজন্যমূলকভাবে হাতি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেই খাতি পেত ভারত। এর অনেক বছর পরে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় হাতি রপ্তানি। অনেকের অবশ্য মত যে, শিশুদের অনুরোধ রক্ষার মধ্যে দিয়ে জাপান বা জার্মানির সঙ্গে নেহরু ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন। সে যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত শিশুদের অনুরোধ ফেরাননি ‘চাচা’ নেহরু। 

ঋণস্বীকার : Unforgettable Gift, Nimi Kurian, The Hindu

Powered by Froala Editor

Latest News See More