‘অ-য়ে অজগর’ থেকে হারাধনের দশটি ছেলে, যোগীন্দ্রনাথের হাতেই শুরু বাংলার শিশুশিক্ষা

একটা সময় পর্যন্ত বাঙালি ঘরের শিশুশিক্ষার পাঠ শুরু হত ‘হাসিখুসি’-তে। এখনও হয় নিশ্চয়ই। তবে যুগের সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষার বাড়বাড়ন্তে যেন ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছে অক্ষর চেনার সেই প্রথম সুরটি। কী সেই সুর? “অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে”। বইয়ের পাতা থেকে আচমকাই মনের মধ্যে এসে গুনগুন করে ওঠে শৈশবের স্মৃতিগুলি। তারপর ঈগল পাখির ভয়ে থাকা ইঁদুর ছানাটিকে সঙ্গী করে মুখ তোলা উটের পিঠে চড়ে পাড়ি দেওয়া আরো বড়ো এক সমুদ্রের দিকে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের (Jogindranath Sarkar) ‘হাসিখুসি’-র মাধ্যমে বুনিয়াদি শিক্ষার শুরু তো এভাবেই। অক্ষর চেনার এর চেয়ে বিকল্প কোনো হাসি-খুশির পদ্ধতি বাংলায় আবিষ্কার হয়নি আজও।

তবে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের কৃতিত্ব শিশুশিক্ষার পরিধি থেকে অনেক বিস্তৃত। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘পাখি সব করে রব’ কিংবা স্কুল বুক সোসাইটির ‘নীতিকথা’-র দিন পেরিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্য সন্ধান করছিল এক নতুন যুগের। শুকনো নীতিকথা নয়, শিশুর মনস্তত্ব ও তার বিকাশের সঙ্গে যেন মিশে যেতে পারে সেই সাহিত্য। কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে দেবে এক মস্ত উড়ান। উনিশ শতকের শেষ লগ্নে কেশবচন্দ্র সেনের ‘বালক বন্ধু’, প্রমাদচরণ সেনের ‘সখা’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’, জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘বালক’-এর মতো পত্রিকার ধারাবাহিক প্রকাশ বাংলা শিশুসাহিত্যে নিয়ে আসে নতুন যুগের বার্তা। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় যোগীন্দ্রনাথের সচিত্র গ্রন্থ ‘হাসি ও খেলা’। সৃজনশীলতায় পরিপূর্ণ এক আশ্চর্য স্কুলপাঠ্য গ্রন্থ, যা বাঙালি আগে দেখেনি কখনও। ‘নিবেদন’ অংশে যোগীন্দ্রনাথ আশা করেছিলেন, “সাধারণের উৎসাহ পাইলে শীঘ্রই ‘ছবি ও গল্প’ নামের আরও একখানি সচিত্র গৃহপাঠ্য পুস্তক প্রকাশ করিবার ইচ্ছা রহিল।”

তিনি তখন সিটি স্কুলের শিক্ষক। এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে সিটি কলেজে ঢুকলেও শেষ করতে পারেননি প্রথাগত পড়াশোনা। বিখ্যাত চিকিৎসক নীলরতন সরকার ছিলেন তাঁর দাদা। পূর্বে তাঁদের পদবি ছিল ‘দেব’। বাংলার শিশুসাহিত্যের সম্ভবত প্রথম গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক রাধাকান্ত দেব ছিলেন তাঁর উত্তরপুরুষ। সেই পরম্পরায় যেন বাহিত হয়েছিল যোগীন্দ্রনাথের রক্তে। ১৮৯২-এ প্রকাশিত হল ‘ছবি ও গল্প’। এই সময়ে ‘মুকুল’ পত্রিকার দায়িত্বও এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। বইয়ের ‘উড ব্লক’-এর কাজের জন্য স্কুলে পৌঁছোতে দেরি হয়ে যেত প্রায়ই। মাইনে কাঁটা যেত প্রতিমাসে। তাই স্কুলের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি মন দিলেন প্রকাশনার কাজে। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সিটি বুক সোসাইটি’। পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘হাসিখুসি’। বাংলার শিশু-কিশোরদের জন্য যেন এক আশ্চর্যজগতের সন্ধান নিয়ে এলেন তিনি। ছড়া আর ছবিতে সহজ হয়ে উঠল প্রাথমিক শিক্ষা। ‘ৎ’ হয়ে গেল বিড়ালের লেজ কিংবা ‘৯’-কার হল ঝুলে থাকা বালক। এর আগে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’-এর চলন বেশি থাকলেও, তার সাধুভাষার গাম্ভীর্যকে সরিয়ে ছন্দের তালে নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন যোগীন্দ্রনাথ। এই গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে।

১৮৯৯-এ প্রকাশিত ‘খুকুমণির ছড়া’য় তুলে আনলেন বাংলার লোকসাহিত্যের বিচিত্র ভাণ্ডার। পাঠ্যপুস্তক আর গল্পের বইয়ের মধ্যে ভাষার ব্যবধান মুছে তাঁর গ্রন্থগুলি হয়ে উঠল শিশুমনের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তরমালা। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বিদেশি সাহিত্য থেকেও। কিন্তু অনুবাদের গুণে সেগুলি মিশে গেছে বাংলার শিকড়ের সঙ্গেই। যেমন ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ ছড়াটির মূল অবলম্বন আইরিশ সাহিত্যের ‘টেন লিটল নিগার বয়েজ’। কিন্তু দেশীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির মান্যতায় হারাধনের সন্তানেরা বাংলায় প্রায় প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। তাদের দুর্ভাগ্য আর পরিণতি ছড়িয়ে গেছে মুখে মুখে। একই সঙ্গে যেন সংখ্যা গণনা শেখার আদর্শ পাঠ এই ছড়া।

আরও পড়ুন
শিশুসাহিত্যপাঠ আর রুকু-টিপু ও গোলাপীবাবুর গল্প

অবশ্য শুধু পাঠ্যপুস্তকের তালিকা দেখলে ভুল হবে। মোট সত্তরটি বই লিখেছিলেন তিনি, যার মধ্যে ছোটোদের রামায়ণ ও ছোটোদের মহাভারত-সহ বেশ কিছু পুরাণ কাহিনি। একদিকে ভারতের প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে সহজবোধ্যভাবে পরিচয়, অন্যদিকে নৈতিক চরিত্রগঠনের প্রচেষ্টার মেলবন্ধন ঘটেছিল এগুলিতে। ‘বন্ধু’ রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে, “ছেলেদের যেমন চাই দুধ ভাত, তেমনি চাই গল্প।... কিন্তু তাদের ঘরের মধ্যে গপ্‌প নেই। এই গল্পের দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্যে যাঁরা কোমর বেঁধেছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য যোগীন্দ্রনাথ।” আবার ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘পশু-পক্ষী’ গ্রন্থটিতে রয়েছে চমৎকার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। ‘মজার মুল্লুক’-এর সব পেয়েছির দেশে পৌঁছোতে হয় কল্পনায় ভর দিয়ে। কারণ সেখানে, “চোখ খুললে যায় না দেখা, মুদলে পরিষ্কার”।

আরও পড়ুন
স্বল্পমূল্যে একের পর এক চিরায়ত সাহিত্য; বইপাড়ার ‘ডার্ক হর্স’ রিফ্লেক্ট পাবলিকেশনের গল্প

একই সময়ে শিশুসাহিত্যের মানচিত্রে উপস্থিত ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ‘সিটি বুক সোসাইটি’ থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর গ্রন্থ। এছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল বসু, কুলদারঞ্জন রায়, অমৃতলাল গুপ্তের মতো শিশুসাহিত্যিকদের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এখান থেকে। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের সময় কাহিনি সংকলন ‘বন্দে মাতরম’-এর মাধ্যমে শিশুমনে গেঁথে দিয়েছিলেন দেশাত্মবোধের বীজ। এই সময়ের পর থেকে অবশ্য তাঁর লেখালেখির মূল ঝোঁকটি পড়ে পৌরাণিক কাহিনির দিকে। ১৯২৩ সালে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান তিনি। তাতেও থামেনি কাজ। তিনি মুখে মুখে বলে চলতেন, আর স্ত্রী গিরিবালা দেবী লিখে রাখতেন খাতায়। প্রুফও দেখতেন নিজেই। অবশেষে ১৯৩৭ সালে মৃত্যু ঘটে যোগীন্দ্রনাথের। 

বাংলার শিশুশিক্ষা ও শিশুসাহিত্য ঋণের শেষ নেই তাঁর কাছে। বদলে হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারেনি কিছুই। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থার রমরমায় কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ছে তাঁর অক্ষরমালারা। এটাই ভবিতব্য কিনা জানা নেই। তবু তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে দুর্বল আলোর সামনে মাথা দুলিয়ে ‘হাসিখুসি’ পড়ে কোনো শিশু। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেকে কল্পনা করে পশু-পাখির দেশের নাগরিক হিসেবে। বাংলার শিশুমনের এই কল্পনার রেশটুকু যতদিন আছে, ততদিন অমর থাকবেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। 

Powered by Froala Editor