প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রায় লক্ষ্মী

মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মীকে চিত্রিত করার প্রবণতা আজকের নয়, বহু পুরনো। হিন্দু শাসকরা সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের প্রতীক মহালক্ষ্মীর প্রতিকৃতি মুদ্রায় খোদাই করতেন। মুসলিম শাসকরাও এই রীতি গ্রহণ করেছিলেন। শাসকরা তাঁদের মুদ্রায় লক্ষ্মীর রূপ খোদাই করতেন, যাতে দেবী কোষাগারের লক্ষ্মীশ্রী বাড়ান। উজ্জয়নের প্রাচীনতম মুদ্রায় গজলক্ষ্মীর চিত্র পাওয়া যায়, যা প্রায় ২৩০০ বছরের পুরনো। একপাশে পতাকা বহনকারী এক ব্যক্তি এবং অন্য পাশে পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে গজলক্ষ্মী। তাঁর এক হাতে পদ্মফুল। তামার এই মুদ্রা খ্রিস্টের জন্মের তিন শতাব্দী আগের। পাঞ্চাল রাজ্যের ফাল্গুনী মিত্রের তাম্রমুদ্রাতেও লক্ষ্মী বিরাজমান। তিনিও প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুলের উপর দাঁড়িয়ে। তাঁর একটি হাত পদ্মের উপর, অন্য হাতে আরেকটি পদ্ম। মাথায় পালকের মুকুট এবং কানে গোল কানের দুল। মুদ্রাটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর।

মহম্মদ গজনভির মুদ্রাতেও অধিষ্ঠিত ছিলেন লক্ষ্মী। মুদ্রার একপাশে চার হাত বিশিষ্ট লক্ষ্মী খোদিত। তাছাড়াও মালওয়ার পারমার, গুজরাটের চালুক্য এবং চৌহান রাজা অজয় দেবসহ সারা ভারতের শাসকদের মুদ্রায় লক্ষ্মীর দেখা মেলা সাধারণ ব্যাপার। নবম শতাব্দীর মুদ্রায় আবার লক্ষ্মীর চারমুখী রূপ পাওয়া যায়।

গুপ্ত রাজবংশের মুদ্রাতে মেলে লক্ষ্মীর ছবি। মথুরার রাজবুলের পুত্র রাজা সোহাসের তাম্রমুদ্রায় গজলক্ষ্মী বিরাজমান। দুই পাশে পদ্ম ফুলের ওপর দাঁড়িয়ে হস্তীযুগল স্নান করাচ্ছেন দেবীকে। সিংহল রাজাদের মুদ্রাতে রয়েছেন দণ্ডায়মান লক্ষ্মী। এই মুদ্রারও দু-পাশে দুটি হাতি, স্নান করাচ্ছে দেবীকে। অর্থাৎ উভয় মুদ্রাতেই হস্তীর দ্বারা অভিষিক্তা লক্ষ্মী। সিংহল মুদ্রাটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর কাছাকাছি বলে মনে করা হয়। মুদ্রাটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, কোষাগারের বিস্তারের প্রতীক হিসাবে ভাবা হত। এই কারণে গুপ্ত রাজারা তাঁদের মুদ্রায় লক্ষ্মী রাখতেনই। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর মূর্তি রয়েছে। অন্য দিকে লক্ষ্মী সিংহের পিঠে উপবিষ্ট।

কুমারগুপ্তের মুদ্রায় সুখাসনে বসে আছেন দেবী লক্ষ্মী। কুমারগুপ্তের তিরন্দাজ মুদ্রায় দেবী সাত পাপড়িবিশিষ্ট পদ্মফুলে সুখাসনে বসে। লক্ষ্মীর এক হাতে পদ্ম। কুমারগুপ্তের আরেকটি মুদ্রায় কুমারগুপ্তকে তরবারি দিয়ে একটি গণ্ডারকে হত্যারত অবস্থায় দেখানো। মুদ্রার বিপরীতে যক্ষের ছাতা দিয়ে দেবীকে ছায়া দান। আর একটি হাতি শুঁড় দিয়ে দেবীকে পদ্ম নিবেদন করছে।

আরও পড়ুন
প্রাচীন ভারতের মুদ্রায় হাতি

আরও পড়ুন
শস্য বুনে-বুনে তৈরি লক্ষ্মীপ্রতিমা, উড়িষ্যার গ্রামবাসীরা আজও ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য

সমুদ্রগুপ্তের দণ্ডধারী ও পরশুধারী মুদ্রা এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের দণ্ডধারী মুদ্রায় লক্ষ্মী শাড়ি, ঘাগরা চোলি, চাদর, গলার মালা, ভুজদণ্ড এবং মুক্তোর মালা পরে সিংহের উপর উপবিষ্ট অবস্থায় চিত্রিত। সমুদ্রগুপ্তের দণ্ডধারী মুদ্রায় বৃত্তাকার মাদুরের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে দেবী। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে সংগৃহীত মুদ্রার মধ্যে পরশুধরীর কিছু মুদ্রায় দেবীকে বাম হাতে পদ্মের কুঁড়ি ধরে থাকতে দেখা যায়। আবার দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং প্রথম কুমারগুপ্তের মুদ্রায় লক্ষ্মী পদ্মাসনা। গুপ্ত শাসক প্রকাশদিয়ার শাসনামলের মুদ্রায় গরুড়ধ্বজা এবং উল্টোদিকে লক্ষ্মী বিরাজমান। সমুদ্রগুপ্তের বীণা বাদক 'টাইপ' মুদ্রার উল্টো দিকেও রয়েছে লক্ষ্মীর চিত্রাঙ্কন। শাড়ি পরিহিতা দেবীকে ঘিরে জ্যোতিশ্চক্র। কুমার গুপ্ত (প্রথম)-এর অশ্বারোহী মুদ্রার উল্টো দিকের পাদদেশে উপবিষ্ট দেবী লক্ষ্মীর শৈল্পিক চিত্র পাওয়া যায়।

এছাড়াও অধুনা পঞ্জাবের রাজন্য জনপদ, কুনিন্দা জনপদের রাজা অমোঘভূতি প্রভৃতি মুদ্রায় লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর কাশ্মীরের রাজা তোরামনের মুদ্রার পিছনে গুপ্ত রাজাদের মুদ্রার মতো লক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। রাজা গঙ্গেয় দেব চতুর্ভুজা লক্ষ্মীকে ১১ শতকের স্বর্ণমুদ্রায় সুখাসনে উপবিষ্ট করেছিলেন। ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী এখানে মুকুট, চুড়ি, কানের দুল ও আর্মলেট (বাহুর আভরণবিশেষ) পরে। একইভাবে, গহদাবালার রাজা গোবিন্দচন্দ্র এবং বুন্দেলখণ্ডের চান্দেলা রাজা বীর বর্মা দেবের মুদ্রাতেও আলো করে রয়েছেন দেবী লক্ষ্মী। নরবর্মণ জেজাকুভক্তির চান্দেলা রাজারাও ১১ শতকের শেষ পর্যায় থেকে ১৩ শতকের তৃতীয় পর্ব পর্যন্ত অনুরূপ মুদ্রা জারি করেছিলেন। এই রাজবংশের কিরমিবর্মণ, সল্লক্ষণ-বর্মন, মদনবর্মণ, পরমর্দি, ত্রৈলোক্যবর্মণ এবং বীরবর্মণেরও সময়কালেও এই ধরনের মুদ্রা পাওয়া গেছে। ত্রিপুরীর কালাচুরি রাজবংশের শাসক গঙ্গেয়দেবের মুদ্রার উদাহরণ অনুসরণ করে পরবর্তীতে বহু শাসক লক্ষ্মী প্রতীকে খোদাই করা নিম্নমানের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা তৈরি করেছিলেন। এভাবেই প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মুদ্রায় 'বসত' করেছেন দেবী লক্ষ্মী।

তথ্যসূত্র :
Ancient Goddess Lakshmi Coins (BLOG | MINTAGE WORLD)
Praacheen sikkon mein bhee ankit hain lakshmee (Dainik Navajyoti)
GUEST POST: The Various Forms of Lakshmi on Ancient Coins - Pratima Durugkar -Translated by: Shivani Kanetkar (Heritage India)
2300 saal pahale ujjain mein sikkon par ukere gae the Gajalakshmee ke chitra -  Vishal Sharma (Dainik Bhaskar)

Powered by Froala Editor